রাজশাহীর পবায় আরএমপি’র মানবতার দেওয়ালে উপকার পাচ্ছে হতদরিদ্রসহ ছিন্নমূল মানুষ
লিয়াকত রাজশাহী ব্যুরোঃ একটি শীতের পোশাক প্রয়োজন তারেক নামের এক তরুণের। এল মানবতার দেওয়ালে। সোয়েটার পছন্দ হলো তার। অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারেন না।
সোয়েটারটি গায়ে দিয়ে তারেক জানান, হাড়কাঁপানো শীতে তার একটি সোয়েটার প্রয়োজন ছিল। পবা থানার মানবতার দেয়াল তার সোয়েটারের প্রয়োজন মিটিয়েছে। তিনি আরো বলেন, তার মতো হতদরিদ্ররা এ মানবতার দেওয়াল থেকে উপকার পাচ্ছে। তিনি ধন্যবাদ জানান রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশকে (আরএমপি)।
রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক গেছে পবা থানা স্পর্শ করে। পবা থানা চার রাস্তার মোড়ে হওয়ায় দিনরাত মানুষের চলাচল থাকে। এরমধ্যে ছিন্নমূল মানুষের আনাগোনাও কম নয়। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতে তাদের অনেকের শরীরে পোশাক নেই এবং অনেকে ছেঁড়া পোশাক পরে জীবন কাটাচ্ছেন। এদের অনেকের পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই। এমন সব মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানোর ভাবনা থেকে পবা থানার প্রধান ফটক সংলগ্ন একটি দেওয়াল বেছে নেওয়া হয়েছে। দেওয়ালটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মানবতার দেওয়াল’।
এই দেওয়ালে ঝোলানো আছে বেশ কিছু হুক। যাদের অতিরিক্ত কাপড় আছে কিংবা কাপড়টি আর ব্যবহার করবেন না, অনেকে সেই কাপড়টি এনে ওই হুকে ঝুলিয়ে যাচ্ছেন। আর যাদের বস্ত্র প্রয়োজন তারা এসে এই দেওয়াল থেকে প্রয়োজনীয় কাপড়টি নিয়ে যাচ্ছেন।
মানবিক পুলিশং এর ধারণা থেকে প্রথমে দেওয়ালটির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন শাহমখদুম জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। গত ১১ জানুয়ারি মানবতার দেওয়াল রাজশাহী আরএমপির পবা মডেল থানায় প্রথম বারের মত উদ্বোধন করেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক। স্থানীয় লোকজন এখন প্রতিদিন পোশাক রেখে যাচ্ছেন এবং সন্ধ্যার মধ্যেই বেশির ভাগ পোশাক নিয়ে যাচ্ছেন হতদরিদ্র লোকজন।
থানার দেওয়াল সংলগ্ন হওয়ায় পবা থানার পুলিশ মানবতার দেওয়ালের সার্বিক তদারকি করছে।
এ বিষয়ে পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে অসহায় ও শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মানবতার দেওয়াল রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি অন্যতম মানবিক উদ্যোগ। তিনি মানবতার দেওয়ালে সমাজের স্বচ্ছল ও বিত্তবান মানুষকে তাদের অপ্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় প্রদান করে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান।
কমিশনার আরো বলেন, শাহমখদুম উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের উদ্যোগে পবা থানায় ও শাহ মখদুম থানায় মানবতার দেওয়ালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরএমপির ১২ টি থানায় মানবতার দেওয়াল স্থাপন করা হবে। এ ধরণের মহৎ উদ্যোগ রাজশাহী আরএমপির ১২ টি থানা, ১২টি পুলিশ ফাঁড়ি, ৩ টি পুলিশ বক্স, ৪টি উপ-পুলিশ কমিশনার কার্যালয় ও ১ টি গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অফিসে মানবতার দেওয়াল স্থাপন করা হবে। এতে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ উপকৃত হবেন পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
এ বিষয়ে শাহ মখদুম উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, মুজিব শতবর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জনতার, স্লোগানকে সামনে রেখে আরএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশে মানবতার দেওয়াল উদ্বোধন করা হয়। সমাজের হতদরিদ্র মানুষগুলো মানবতার দেওয়াল থেকে কাপড় নিয়ে উপকৃত হবে। এতে মানুষের সঙ্গে পুলিশের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে ও পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
মানবতার দেওয়াল সম্পর্কে স্থানীয় সাংসদ আয়েন উদ্দিন জানান, আমাদের সমাজের অনেক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আছে, যারা চক্ষু লজ্জার কারনে শত অভাবে থাকলেও চাইতে পারে না। তাদের জন্য মানবতার দেওয়াল আশীর্বাদ স্বরূপ। তাই আমি পবা ও মোহনপুর উপজেলার সকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নিজ কার্যালয়ে পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে মানবতার দেওয়াল স্থাপনের কথা বলেছি। তিনি এই উদ্যোগ গ্ৰহণ করার জন্য আরএমপির সকল সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
কাটাখালি পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী জানান, মানবতার দেওয়াল নিম্ন আয়ের মানুষ ও দরিদ্র শীতার্ত মানুষের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে মানবতার দেওয়াল স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি মানবতার দেওয়াল সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের সুসম্পর্ক তৈরিতে সেতু বন্ধন সৃষ্টি করবে। তাই এই মহৎ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি আরএমপি পুলিশ কমিশনার মোঃ আবু কালাম সিদ্দিক কে ধন্যবাদ জানান।
পবা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মো. গোলাম মোস্তফা জানান, মানবতার দেওয়াল স্থাপনের পর প্রতিদিন অনেক মানুষ কাপড়-চোপড় রাখছেন এবং যাদের প্রয়োজন কাপড়-চোপড় নিয়ে যাচ্ছেন।
ওসি আরো জানান, হ্যান্ড মাইক ও মসজিদের মাইকে মানবতার দেওয়াল সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা করা হচ্ছে তাই প্রতিদিন মানবতার দেওয়ালে সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নওহাটা পৌরসভার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রকিবুল ইসলাম, মোঃ একরামুল হক ও মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। তারা সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহব্বান জানান এবং এই মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আরএমপি পুলিশ কমিশনার মোঃ আবু কালাম সিদ্দিক এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।
ছিন্নমূল নারী মমতাজ বেগম বলেন, গতবার শীতে গরম কাপড়রের অভাবে বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম। এবার পবা থানার দেয়াল থেকে গরম কাপড় নিয়েছি। শীতে তেমন কষ্ট পাইনি। তিনি আরো বলেন, এভাবে যদি সমাজের ধনী মানুষরা এগিয়ে আসে তাহলে আমাদের মতো গরীব মানুষরা অন্তত শীতের কষ্ট থেকে বাঁচবে।
সহায় সম্বলহীন রিয়াজ আলী জানান, তিনি এবছর শীতে পবা থানার দেয়াল থেকে গরম কাপড় নিয়েছেন। তিনি এভাবে দেয়ালের মাধ্যমে গরীবদের মাঝে গরম কাপড় পৌঁছে দেয়ার জন্য আরএমপি’র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
এ বিষয়ে নওহাটা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ওমর আলী বলেন, পবা থানায় মানবতার দেয়াল দেখে তিনিও তার বিদ্যলয়ে মানবতার দেয়াল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমন মহৎ উদ্যোগ নেয়ায় আরএমপি কমিশনার ও আরএমপি’র সকল সদস্যদের ধন্যবাদ জানান।