বিজয়ের উল্লাস এবং প্রাসঙ্গিক কথা
মোহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত হোসেন :ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির মাস। বিশ্বের মানচিত্রে ’বাংলাদেশ’ নামক একটি রাস্ট্রের জায়গা করে নেয়ার মাস। বাঙালি জাতির গর্ব আর অহংকারের মাস। এটি কেবলই একটি মাস বা একটি দিন নয় বরং একটি রক্তাক্ত ইতিহাস। ডিসেম্বর মাস বাঙালি জাতিসত্তার অনন্য এক চতেনার মাস। লক্ষ শহীদের স্মৃতি বিজড়িত মাস। বীরাঙ্গনাদের করুণ ইতিহাসের মাস। লাল-সবুজের পতাকার মাস। প্রাণপন লড়াইয়ের মাস।
স্বাধীনতাকামী সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় সংকল্পে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর অজস্র মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা আর আমরা খুঁজে পেয়েছি গৌরব আর অহংকারের ’বিজয় দিবস’। বিজয়ের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ এখন অর্ধশত বছরে। কিন্তু প্রাণের এই দেশ কি তার অভীষ্ঠ্য লক্ষে পৌছুঁতে পেরেছে! বিজয়ের মাস আসলেই শুধু আমাদের মাঝে দেশপ্রেম উপচে পড়ে। ডিসেম্বর আসলে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, লেখক, কবি, শিল্পী, সুশীল শ্রেণি, পেশাজীবি, রাজনীতিবিদ কিংবা তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা মাতৃভূমির প্রেমে যেন উদ্বেল হয়ে ওঠে! এই একটি দিনের জন্যই যেন সব দেশ্রপ্রেম! ষোলই ডিসেম্বর শহীদ মিনারে খালি পায়ে ফুল দেয়া, মিছিল করা, বিশেষ নাটক বা পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের মধ্যেই যেন আমাদের কাছে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে বিজয়ের গৌরবগাঁথা ত্যাগের ইতিহাস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম একই আবেগ আর শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। দেশ-মাতৃকার প্রতি আমাদের দায়িত্ব, আবেগ-অনুভূতি সবই যেন আজ সিজনাল! শীত আসলেই যেমন শীত পিঠা, খেজুর রস, বর্ষায় কদম আর শরতে কাশফুল নিয়ে ভাবি তেমনি ডিসেম্বর আসলেই আমরা বিজয়ের কথা ভাবি। এই একটি দিন পার হয়ে গেলে আমাদের চেতনার সকল দ্বার বন্ধ করে আমরা ফিরে যায় আমাদের পরনো চরিত্রে।
বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত যেন দেশের প্রতি আমাদের আর কোন দায়-দায়িত্ব নেই! অথচ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত এই বিজয় আজো সাধারণ মানুষের কাছে পরিপূর্ণ বিজয় হিসেবে ধরা দেয়নি। পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হলেও প্রাণের মুক্তি মিলেছে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ! দেশ এগিয়েছে অনেক। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে প্রচেষ্টা চলছে, উন্নয়নের গতিধারাও চলমান কিন্তু মানুষের মৌলিক অধিকার এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি পুরোপুরি। এখনো চলছে দূর্নীতির লাগামহীন প্রতিযোগীতা, পেশীশক্তির দৌরাত্ম্য, নারী ও শিশু নির্যাতন। চলছে নৈতিকতা আর সততার চরম দূর্ভিক্ষ। গণতন্ত্র এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আজও পায়নি এদেশের মানুষ। সার্বজনীন ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত গড়ে উঠেনি। মৌলিক অধিকারের অন্যতম ’স্বাস্থ্য সেবা’ তা থেকেও দেশের বিরাট একটি অংশ বঞ্চিত। সর্বসাধারণের জন্য এখনও কোন যুতসই স্বাস্থ্যনীতি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
বিজয় দিবসকে শুধুমাত্র একটি উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বছরব্যাপী কীভাবে বিজয়ের আমেজ আমাদের জীবনে থাকে সেই দিকে আমাদের দৃষ্টিপাত করা এবং সেই লক্ষে এগিয়ে যাওয়া জরুরি। বিজয়ের রেশ যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনুসঙ্গ হয়ে থাকে। সারাবছর যেন আমরা স্মরণ করি দেশ মাতৃকার জন্য যারা যুদ্ধ করেছেন সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে যেন সমুন্নত রাখতে পারি সেই প্রচেষ্টা থাকতে হবে সকলের মনে। সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকে যেন দেশ-জাতির কল্যাণের কথা ভেবে দেশের উন্নয়নে মেধা-মনন ঢেলে দিই। দেশ-জাতির কল্যাণই যেন হয় ব্যক্তির কল্যাণ। ভেদাভেদ, প্রতিহিংসা আর ক্ষমতা দখলের অগনতান্ত্রিক মনোবৈকল্য বাদ দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই বিজয়ের এই আনন্দ-উল্লাস সত্যিকার অর্থে পরমানন্দ হয়ে উঠবে।
লেখক: কলামিস্ট
সৌদি আরব।