ঢাকা | ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪ - ৪:৫৭ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনামঃ

সৌদি নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ডঃ মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর বিপিএম (বার) কিছু কথা

  • দৈনিক নবোদয় ডট কম
  • আপডেট: Thursday, August 10, 2023 - 8:27 am
  • News Editor
  • পঠিত হয়েছে: 222 বার
নিজস্ব প্রতিবেদক: আমি সৌদি আরবের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে যোগদান করি ২০২০ এর আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের ভোরে। আজ ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের দুই তারিখ কয়েকদিন পরই তিন বছর হবে, আলহামদুলিল্লাহ।
আমি যখন সৌদি আরবে আসি সারা পৃথিবী  COVID এ  বিপর্যস্ত, বিশ্বের প্রায় সকল দেশই KOVID এর করাল গ্রাসে জর্জরিত। প্রায় সব কিছুই স্থবির, বন্ধ। এমন কি বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের বিমান চলাচল ও বন্ধ। সৌদি আরবের সাথে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সপ্তাহে বাংলাদেশ বিমানের দুই একটা স্পেশাল ফ্লাইট আসতো শুধুমাত্র কিছু কার্গো নিয়ে বাংলাদেশ থেকে।
কোনো প্যাসেঞ্জার বিমান গুলো আনা নেয়া করতো না।  এমন অবস্থায় উভয় সরকারের বিশেষ সম্মতিক্রমে আমি এবং আমার স্ত্রী এমনই একটি বিমানের বোয়িং 777-300 ER স্পেশাল ফ্লাইটের একমাত্র! (নাকি দুইমাত্র!) যাত্রী হয়ে রিয়াদে আসি। যে ফ্লাইটের ধারণ ক্ষমতা ৪১৯ জন, ৩৫জন বিজনেস ক্লাসের যাত্রী সহ সেখানে যাত্রী হিসেবে আমরা মাত্র দু’জন,স্বামী এবং স্ত্রী! আমাদের সাথে ইন্টারন্যাশনাল বিমান সংস্থার রুল অনুযায়ী  বোয়িং 777- 300 ER এর জন্য প্রয়োজনীয় ১১জন ক্রুই ছিলেন। বলা বাহুল্য নিয়মিত কার্গো ছিল হোল্ডে।
>
> সৌদি আরবে আসার আগে পররাষ্ট্র ক্যাডারের আমাদের ৮৪ ব্যাচের শহিদুল ইসলাম, যিনি তখন মালয়েশিয়ার অ্যাম্বাসেডর ছিলেন তিনি সৌদি আরবের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরই মালয়েশিয়াতে গিয়েছিলেন তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্রিফিংয়ের এক পর্যায়ে বললেন, ‘দোস্ত সৌদি আরবে একটা অত্যন্ত অভাবনীয় বিরল সুযোগ আসবে তোমার জীবনে পবিত্র কাবা শরীফের ভিতরে ঢোকার এবং নামাজ পড়ার’। সৌদি আরবে আসার পর থেকে অপেক্ষায় ছিলাম কবে সেই বিরল সুযোগ আসবে।
>
> আজ বুধবার ২ আগস্ট ২০২৩, ১৫ মহররম ১৪৪৫ সেই অকল্পনীয় বিরল সৌভাগ্যের সুযোগ এলো। প্রতি বছর ১৫ মহররম কাবাশরীফের দরজা খুলে কাবা ঘরের ভিতরে পরিষ্কার করা হয়। আজ সেইদিন। ২০২০ এ COVID এর জন্য অনুষ্ঠানটি হয়নি, ২০২১ শে খুবই অল্প সময়ের নোটিশে জেদ্দায় অবস্থিত কনসাল জেনারেলদের বলা হয়। এবার রিয়াদে অবস্থিত আমাদের মুসলিম অ্যাম্বাসেডরদের পালা।
একদিন আগেই ফরেন মিনিস্ট্রি থেকে আমাদের জানানো হলো সকল মুসলিম অ্যাম্বাসেডর যারা নিমন্ত্রণ পেয়েছেন ‘Kaba Washing Ceremony’ এর তারা Jeddah Ministry of Foreign Affairs অফিসে ২ আগস্ট ভোর দুইটায় (১ আগস্ট দিবাগত রাত) হাজির থাকবেন। আমি সহ আমাদের সকল মুসলিম অ্যাম্বাসেডর গন গতকালই রিয়াদ থেকে জেদ্দা এসে পৌঁছেছি। ভোর রাত দেড়টায় জেদ্দা কনসাল জেনারেল নাজমুলের পাঠানো ফ্ল্যাগ কার করে রওয়ানা দিলাম জেদ্দা হজ্জ মিশন থেকে। রাস্তা ফাঁকা পেয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ফরেন অফিসে। গেটে ঢুকার আগেই দেখি গাড়ির বেশ লম্বা লাইন, আমার আগে ছিলেন পাকিস্তানের অ্যাম্বাসেডর। গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন জেদ্দা ফরেন অফিসের প্রধান, সহাস্যে স্বাগতম জানালেন গালে গাল মিলিয়ে। এগিয়ে গেলাম, কিছু দূরেই ছিলো একটি ডেস্ক সেখানে সাজানো আজকের আমন্ত্রিত অ্যাম্বাসেডর অতিথিদের জন্য বিশেষ আইডি কার্ড। আইডি নিয়ে দোতলায় গেলাম, বেশ বড় হলরুম।
৫০টির মতো সোফা পাতা ইংরেজি U শেপে তিনদিকে। পাশে আরেকটি হলরুম একটু ছোটো। আমার আগে প্রায় ১৫/২০ জন এসেছেন, তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে বসলাম আমার সোফায়। টেবিলে খেজুর সাজানো, সৌদি কফি যেটাকে এরা বলে গাওয়া নিয়ে এলো একজন। সোয়া দুইটার মধ্যে প্রায় ৭৫ জন অ্যাম্বাসেডর (এদের মধ্যে অল্প কয়েকজন কনসাল জেনারেল) এসে পৌঁছাল। ঠিক আড়াইটায় আমাদের নিয়ে আসা হলো নিচে গাড়ি বারান্দায়। তিনটি বাসে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের কয়েকজন উঠে বসলাম একটায়। প্রতিটি সিটে একটি করে প্যাকেট ওতে রয়েছে দুটি ভেনিলা কাপ কেক, কোকোয়া ক্রিমের ফিলিং দেয়া একটি করে ক্রোসেন্ট (Croissant), HERSHEY’S COOKIES N CREME একটি, এক প্যাকেট RITZ Crackers, একটি জুস এবং এক বোতল পানি ভোরের নাস্তার জন্য মনে হয়।  আমার পাশের সিটে বসলেন নাইজেরিয়ার অ্যাম্বাসেডর। কিছুক্ষণ পরই বাসগুলো ছেড়ে দিলো, সামনে দুটো পুলিশ কার এবং পিছনে দুটো পুলিশ কার। ভোর চারটায় এসে পৌছালাম হারাম শরীফের সাথে লাগোয়া সৌদি বাদশার রয়েল গেস্ট প্যালেসে। কিছুদিন আগেই আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে এসে থেকেছি কয়েকদিন এই রয়েল গেস্ট প্যালেসে হজ্জের সময় সৌদি বাদশার মেহমান হিসেবে,
সেই গল্প করবো আরেকদিন ইনশাআল্লাহ্। এখানেও খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে, স্যান্ডউইচ, কেক, কুকিজ, চা, কফি ইত্যাদি। অজু করে রেডী হলাম। এখানে এসে দেখলাম বেশ কিছু সৌদি উচ্চপদস্থ সরকারি এবং বেসরকারি গণ্যমান্য ব্যক্তিগন আগে থেকেই বসে আছেন। সব মিলিয়ে আমরা প্রায় দেড়শ জন এর মত হবো মনে হয়। আমাদের সারিবদ্ধ ভাবে নিয়ে গেলো কর্ডন করে মাহতাফের খোলা জায়গা যেখানে শেষ হয়েছে তার শেষ মাথায় মসজিদের শুরুতেই লাগোয়া দক্ষিণ দিকের লাউডস্পিকারের নিচে সবুজ বাতি যেখানে রয়েছে, তার নিচে ঘেরাও দেয়া সবুজ কার্পেট বিছানো জায়গায়। ওখানে আমরা তাহাজ্জুদ পড়লাম। সম্ভবত ভোর তিনটা হতে মাহতাফে আর কাওকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না ওমরাহ করার জন্য। অল্প কয়েকজন ওমরাহ কারিকে দেখলাম তাওয়াফ করছে।কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান দিলো, নামাজ পড়ে আমরা বসে আছি। বিপুল সংখ্যক পুলিশ ঢুকলো মাহ্তাফে চারিদিকে ঘিরে ফেললো। ফজরের একঘন্টার মধ্যেই একদম কমে গেলো ওমরাহর লোকজন।
ইতিমধ্যে কাঠের সিড়ি লাগানো হলো কাবাশরিফের দরজায়, কাবা ঘরের চাবি বহনকারী সন্মানিত ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা অদূরে বসে দেখলাম তিনি সহ বেশ কয়েকজন সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন এবং কাবা ঘরের দরজা খুলে দেয়া হলো। সবকিছু প্রস্তুত হলে আমাদের পুলিশ কর্ডন করে নিয়ে যাওয়া হয় ২৫ জন করে করে তিনটি গ্রুপে। আমাদের বলা হয়েছিল দুই রাকাত নামাজ পড়তে পারার সুযোগ পাবো আমরা। আমি প্রথম দলে ঢুকে যাই। আমাদের দলে ছিলেন ভারত, নাইজেরিয়া, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান, লিবিয়া, লেবানন, নাইজার, আলবেনিয়া সহ আরো বেশ কিছু দেশের অ্যাম্বাসেডরগন। সিড়ি দিয়ে কাবা ঘরের দরজার দিকে উপরে উঠতে উঠতে ভীষণ ভাবে বুকটি দুরু দুরু করে কাপছিল। ভিতরে ঢুকে প্রথমেই আমি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে অসীম কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া জানাই দুই রাকাত নামাজ পড়ে। জানি আমাদের অবস্থান সময় অত্যন্ত কম, প্রতিটি সেকেন্ডকে কাজে লাগাতে চাচ্ছিলাম। প্রতি দুই রাকাত নামাজ পড়ে অন্য ডিরেকশনে আবার দুই রাকাত পড়ছিলাম।
এইভাবে কাবা ঘরের চারিদিকের দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘুরে ঘুরে মোট ১৬ রাকাত নামাজ পড়ার সুযোগ পাই। আমাদেরকে ছোট্ট একটি টাওয়ালের টুকরো দেয়া হয়েছিল ভিতরে ঢোকার পর তা ছিল জমজম পানি এবং গোলাপের নির্যাস ভিজানো এবং সৌদি উদ সহ সুগন্ধি মেশানো। আমি একটা রুমাল নিয়ে গিয়েছিলাম পকেটে করে, ঐ দুটো কাপড় দিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়ে পড়ে কাবাঘরের ভিতরের দেয়ালগুলো মুছছিলাম। কাবাঘরের ভিতরের দেয়াল এবং মেঝে সাদা মার্বেল পাথরের। দেয়ালের নিচের দিকে সবুজ মার্বেলের স্কেটিং রয়েছে। বিভিন্ন দেয়ালে কোরআনের আয়াত সম্বলিত মার্বেল পাথরে খোদাই করা কারুকার্যময় কয়েকটি শিলালিপি বসানো আছে ওগুলোও মুছছিলাম। কাবাঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলে হাতের ডান দিকে হাতিমের দিকের কোনায় আনুমানিক (৬ফুটx১০ফুট) এর খুবই ছোট্ট একটি ঘরের মতো রয়েছে যেটার আবার স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া (স্বর্ণের ও হতে পারে) ছোট্ট একটি দরজা রয়েছে যা বন্ধ ছিল (আমার ধারণা এখানে সম্ভবত কাবা ঘরের ছাদে যাওয়ার সিড়ি রয়েছে)ওটাতে ও কোরআনের বাণী রয়েছে তাও মুছলাম।
কাবাঘরের ভিতরে তিনটি গোল খিলান রয়েছে যা কাঠের প্যানেলে আবৃত, মাঝে মাঝে স্বর্নখচিত স্কেটিং রয়েছে সেগুলোও মুছলাম। জানিনা কিভাবে আধা ঘণ্টার মতো সুযোগ পাই কাবাঘরের ভিতরে থাকার! এরমধ্যে আমাদের তিন গ্রুপের সবাই এসেছে এবং প্রায় সবাই চলেও গিয়েছে। এই পর্যায়ে জেদ্দার  ফরেন মিনিষ্ট্রির প্রধান আমাকে আবিষ্কার করলেন এবং অনুরোধ করলেন শেষ করতে। আলহামদুলিল্লাহ। অনাবিল শান্তি, তৃপ্তি এবং জগৎ সমূহের প্রতিপালকের আমার প্রতি অসীম করুণার কথা মনে হয়ে কৃতজ্ঞতায়  হুহু করে কান্না চলে এলো ভিতর থেকে তার প্রতি কোটি কোটি শুকরিয়া জানিয়ে কাবা ঘরের মূল দরজা মুছে নেমে এলাম সিড়ি দিয়ে। কাবা ঘরের মধ্যে করুণাময়ের দরবারে সিজদায়ে পড়ে দোয়া চেয়েছি মৃত বাবা মা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, চেনা অচেনা সকল মুসলমান, স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের সবার জন্য, বাচ্চাদের জন্য, মৃত এবং জীবিত আত্মীয়স্বজনের জন্য, দেশের জন্য, প্রধানমন্ত্রীর জন্য, পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য। আমাদের কাওকেই কোনো ছবি তুলতে দেয়া হয় নি, পূর্বেই কড়া নিষেধ ছিল। মনের ক্যামেরায় তুলে নিয়ে এসেছি কাবা ঘরের ছবি, যা আজীবন অমলিন থাকবে।
>
> (লেখাটির সাথে কয়েকটি ছবি দিয়েছি। এরমধ্যে প্রতিটি ছবিই আরবনিউজ পত্রিকা থেকে নেয়া আমার ব্যক্তিগত ছবি ছাড়া। পুরো কাবা ঘর ঘিরে যে ছবিটি তা এই বছর ২০২৩ এর, কাবা ঘরের ভিতরের ছবিগুলো ২০২২ এ’ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যখন কাবা ঘর পরিষ্কার করেন সেই সময়ের। আমি যে রুমাল দুইটি কাবা ঘর মোছার জন্য ব্যবহার করেছিলাম তার একটি ছবি এবং আমরা কয়েকজন অ্যাম্বাসেডর যাঁরা একত্রিত হয়েছিলাম ঐ অনুষ্ঠানের জন্য তাদের ছবি ব্যক্তিগত ক্যামেরায় তোলা)।
> ০২ আগস্ট, ২০২৩ জেদ্দা।