🛑 নিয়তির অশ্রু 🛑 [ ছোট গল্প ]
রিটন মোস্তাফা [ রিটন ]
রাতু খুব বেছে বেছে জিনিস পত্র কিনছে। আর সব ক্ষেত্রেই ত্রয় এর পছন্দকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আর হয়তো এটাই ভালোবাসা । পরশু রাতু আর ত্রয় এর পাঁচ বছরের প্রেম সফল হতে যাচ্ছে । রাতুর বড়লোক বাবা শেষ পর্যন্ত এই বিয়েতে রাজি হয়েছে। রাতু তাঁদের একমাত্র সন্তান । প্রচন্ড প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হয়েছে রাতু। অভাব বা না শব্দটার সাথে তাঁর বাবা মা কখনোই পরিচয় হতে দেয়নি তাঁকে। যা চেয়েছে রাতু তাঁর বাবা মার কাছে সবই পেয়েছে।
“মা এই ঘড়িটা দেখ, এটা পড়লে ত্রয় কে খুব মানাবে”
মা মুচকি হেসে সম্মতি দিলেনঃ “নিয়ে নাও তাহলে ওর জন্য”
সারদিন ধরে মা মেয়ে প্রচুর বিয়ের বাজার করলো, যার বেশিরভাগই ত্রয় এর জন্য । এখানেও তাঁর মা বুঝে গেছে যে তাঁর মেয়ে কতোটা ভালোবেসে ফেলেছে ত্রয় কে।
রাত এগারোটার দিকে রাতু ত্রয় কে ফোন করলো।
“হ্যালো ত্রয়, তুমি আজ একবারও ফোন দেওনি কেন?”
“এই একদম মিথ্যে বলবে না রাতু, দুপুরে দিয়েছিলাম । তুমিই তো বললে শপিং এ আছো। আমি আর ঝামেলা করিনি।”
ত্রয়,রাতে খেয়েছ?
না, রান্না করার সময় পাইনি। তবে এখন তুলে দিয়েছি। ম্যাচ এ আজ বিদ্যুত ও নেই।”
“আর একদিন পর থেকে তোমার ম্যাচ এ থাকা খাওয়ার কাহিনি শেষ।”
“কিন্তু রাতু, আমার এখনও খুব একটা মন টানছে না যে শশুর এর কম্পানিতে চাকরি এবং তাঁরই মেয়ের সাথে তাঁরই অন্য আরেকটি ফ্লাটে সংসার করতে। কেমন যেন…..”
রাতু এবার ক্ষেপে গলো। ” দেখ ত্রয়, আমি যুক্তি দিয়ে তোমাকে সব বুঝিয়েছি। আমার কোন ভাই নেই বোনও নেই । বাবা বহু শারীরিক সমস্যা মোকাবেলা করছে। তার এতো সব দেখার জন্য নিজস্ব কেউ নেই তাঁর। আমি ব্যতীত অন্য উত্তরাধিকার ও নেই । আর আমার বাবা মা শুধু তোমাকে জামাই না সন্তানদের মতোই এক্সেপ্ট করেছে। আর তোমারও এক বোন ছাড়া কেউ নেই । আমরা তোমার সব হতে চাই সেটা কি অন্যায়? সুতরাং আর একদিন যদি এসব নিয়ে তুমি আমাকে বলা তো দূরের কথা ভাবতেও পারবেনা।”
“আচ্ছা আচ্ছা । শপিং শেষ?”
“হ্যাঁ, আমি জানি তোমার ঘড়ি খুব পছন্দ। আর এ জন্য আমি দুটো ঘড়ি কিনেছি । তোমাকে পড়লে খুব সুন্দর লাগবে, তোমার পছন্দও হবে।
” রাতু,তোমাকে আমার সব থেকে বেশি পছন্দ। তাহলে তোমার কেনা জিনিসটা পছন্দ হবেনা কেন?”
আজ রাতু আর ত্রয় এর বিয়ে। অনেক অনেক মানুষ কমিউনিটি সেন্টারে এসেছে অতিথি হয়ে। জাঁকজমক আয়োজন । কোথাও কোন ঘাটতি রাখেননি রাতুর বাবা । একমাত্র মেয়ে । ভালোবাসার অস্তিত্ব। সে একটুও অভিযোগ বা কষ্ট পাক তিনি কখনোই সেটা চান না ।
“কীরে রাতু, বিয়ের সাজে তো তোকে পরীর মতোই লাগছে।”
রাতুর মামাতো বোন রুমকি রাতুর পাশে গিয়ে বসলো। ” খুব ভালোবাসিস ত্রয় কে তাইনা? ”
রাতু লাজুক হেসে বড় বোনের দিকে তাকালঃ ” সেটা জানিনা আপা, তবে ওর সাথে সম্পর্ক হবার পর থেকে ওকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনা, থাকতেও পারিনা। আর এটা যতো দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে।”
“খুবই ভালো রে। তোরা সুখী হ এটাই আমরা চাই ।”
” হ্যাঁ আপা দোয়া করো, ও এতিম । ছোট থেকে খুব কষ্ট আর সংগ্রাম করে এতো দূর এসেছে। খুবই ট্যালেন্ট আর সরল মানসিকতার । সব থেকে বড় কথা, ও প্রচন্ড রকম ভালোবাসে আমাকে আর খেয়ালও রাখে।”
“হুম, তোদের সুখে দেখলে খালা খালুও শান্তি পাবে। ওরা তোর বিন্দুমাত্র কষ্ট সহ্য করতে পারে না ”
অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন রাতুর বাবা । বারান্দার এপাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছেন আর আসছেন। তার পিছনে পিছনে ম্যানেজার ও আপডাউন করছে।
” ওদের আসার কথা এগারোটায়। এখন বারোটা বেজে গেছে। ত্রয় এর ফোনটাও বন্ধ। আফজাল, হচ্ছে টা কি…?”
” আমিও বুঝতে পারছিনা স্যার। আমি কি ওর বোনের বাড়িতে যাব? খোঁজ নেব কি হয়েছে? এমন তো করার কথা না। ফোন বন্ধ কেন?”
“না আর একটু দেখি, তারপর নাহয় দেখা যাবে। সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কি একটা অবস্থা!”
বারোটা পঁচিশ এর দিকে রক্তাক্ত একজন কমিউনিটি সেন্টারে মেন ফটক দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ঢুকলো। দারোয়ান ঠেকাবার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুই শুনছে না ছেলেটা। হট্টগোল দেখে এগিয়ে এলেন রাতুর বাবা সহ অনেকেই । ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো রাতুও। রাতুকে দোতলার ব্যালকনিতে দেখে ছেলেটা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠলো।
” রাতু আপা সব শেষ। ঐ মাতাল ট্রাক ড্রাইভার সব শেষ করে দিলো,সব…..”
ত্রয় এর বন্ধু ফজলের কথা শুনে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো রাতুও।
” কি হয়েছে ফজল ভাই? তোমার শরীরে এতো রক্ত কেন? ত্রয় কোথায়? আমার ত্রয় কোথায়?
” গাড়িতে আমরা চারজন এখানেই আসছিলাম। ঐ মাতাল ট্রাক ড্রাইভার এতো জোরে এসে আমাদের গাড়ির উপর পরল যে, সব শেষ আর ত্রয় ওখানেই….”
দোতলা থেকে নীচে রাতু যেন উরে এলো। ফজলের জামা ধরে ঝাঁকাতে লাগলো।
” আমার ত্রয়, আমার ত্রয় কোথায় ফজল ভাই ”
ত্রয় এর বন্ধু ফজল হাঁটু মুড়ে ওখানেই বসে পড়ল।
“আমরা তিনজন জখম হলেও ত্রয় কে শেষ করে দিয়ে গেছে ঐ ঘাতক। ত্রয় ওখানেই মারা গেছে”
রাতু গাছ থেকে ঝড়ে পড়া শুকনো পাতার মতো যেন ঝড়ে পড়ল মাটিতে। জ্ঞান হারলো।
সেই দিনের পর থেকে বহুদিন পর এখনও রাতু নীরব। চার মাসেও ওর কোন উন্নতি হয়নি। একা একা থাকে আর একটু পরপর “ত্রয়” বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে……..।