ভবিষ্যতে হয়তো যমুনায় চারটি, পদ্মায় আরও দুটি সেতু লাগবে
গবেষক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান। শুধু পদ্মা সেতু নয়, স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই জামিলুর রেজা চৌধুরী কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। গত ২৮ এপ্রিল ৭৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। পদ্মা সেতু নিয়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক সাময়িকী বিজ্ঞানচিন্তার মে, ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যা নিয়েছিলেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম এবং রাজীব হাসান। পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
আব্দুল কাইয়ুম
আব্দুল কাইয়ুমরাজীব হাসান
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮: ৫৪
অ+
অ-
ছবি: জাহিদুল করিম
ছবি: জাহিদুল করিম
পদ্মা সেতু নির্মাণে মূল চ্যালেঞ্জ কী?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: আমাদের দেশের জন্য বড় বড় নদীর ওপর সেতু তৈরিতে দুটি বড় চ্যালেঞ্জের একটি হচ্ছে রিভার ট্রেইনিং। অর্থাৎ নদীশাসনের মাধ্যমে নদীটির গতিপথ স্থিতিশীল করে সেতুর নিচ দিয়ে যাতে প্রবাহিত হয়, তা নিশ্চিত করা। কাজটি ভালোভাবে করা না হলে দেখা যাবে, সেতু যেখানে থাকার সেখানেই থাকবে। অন্যদিকে নদী তার পথ বদলে সেতুকে পাশ কাটিয়ে অ্যাপ্রোচ রোডকে প্লাবিত করে বা ভেঙে ফেলে সেতুর কাঠামোটা নষ্ট করে ফেলবে। তাই নদীশাসন এ কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আমাদের দেশের নদীগুলো আবার ভিন্ন প্রকৃতির সমস্যার জন্য বিখ্যাত। এগুলো যেমন তীব্র স্রোতে এগিয়ে চলে, তেমনি পাড় ভাঙার (ইরোশন) কারণে প্রতিবছর নদীর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। অধিকাংশ নদী তাদের অবস্থান খুব অল্প সময়েই পরিবর্তন করে ফেলে। নদীগুলোর প্রকৃতিও আলাদা। কিছু নদী সর্পিলাকার, এঁকেবেঁকে চলাচল করে। এদের বলে মিয়েন্ডারিং। এগুলো আঁকাবাঁকা হয়ে বহু দূর পর্যন্ত যায়। একই চ্যানেল অনেক দূর পর্যন্ত যেতে যেতে একসময় শর্টকাট পথ বের করে ফেলে। ফলে অশ্বক্ষুরাকৃতির বাঁওড় সৃষ্টি করে। আরেক ধরনের নদী হলো ব্রেডেড। এটাকে মেয়েদের চুলের বিনুনির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এ ধরনের নদীর একাধিক চ্যানেল থাকে, যেগুলো একটি অপরটির ওপর দিয়ে ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকে। যমুনা ব্রেডেড জাতীয় নদী। তবে পদ্মা একটি মিয়েন্ডারিং নদী।
জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী
নদীশাসনের জন্য এখানে কি নতুন কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: এই সেতু করার সময় নদীশাসন করতে গিয়ে যে পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার নাম গাইড বান্ড উইথ ফলিং অ্যাপ্রোন। এ ক্ষেত্রে নদী পাড় থেকে যত দূর খনন করা যায়, তা করে রাখা হয়। আধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে ২০-২৫ মিটার পর্যন্ত খনন করে স্লোপ বা ঢাল তৈরি করা হয়। এর ওপর ভারী পাথর ফেলে রাখা হয়। কিংবা অনেক সময় জিও টেক্সটাইলের বালুভর্তি ভারী ব্যাগ ফেলে রাখা হয়। ফলে ওই অংশের নরম মাটি যদি কোনো কারণে ভেঙে নিচে সরেও যায়, তাহলে ওই ভারী পাথর বা ব্যাগ আরও নিচে পড়ে গিয়ে শক্ত স্তর সৃষ্টি করে, যা নদীর গতিপথ পরিবর্তনে বাধার সৃষ্টি করবে। ড্রেজার দিয়ে খননে বঙ্গবন্ধু সেতুর ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক ড্রেজার ব্যবহার করে আমরা খনন করতে পারতাম সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ১৮ মিটার, যা কয়েক বছরের প্রযুক্তির উন্নতির ফলে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ মিটারে।
এখন আমি যদি সেতুর নিচের অংশ দিয়ে ট্রেনকে বহন করতে চাই, তাহলে আমাকে প্রায় ১৫০ মিটারের স্ট্রেন্থ বার ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ট্রেনকে ঢালুপথে চালনা করতে হবে
নদীশাসনের ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের ব্যবহার বেশ প্রচলিত। বঙ্গবন্ধু সেতুসহ দেশের বেশ কিছু সেতুতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। পদ্মা সেতুতে কি এর চেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে?
জামিলুর রেজা চৌধুরী: খুব বেশি কিছু এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়নি। এখন আমরা ঢাকায় বসে আমাদের দেশের নদীর কাঠামোগত মানচিত্রগুলো খুঁজে পাই। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু নিয়ে যখন আমরা কাজ করছিলাম, তখন কিন্তু বিষয়টা এত সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু সেতুর সময় একটি সমস্যা ছিল। সার্ভে অব বাংলাদেশ নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে ওদের বানানো ম্যাপ আমাদের দিতে চায়নি। পরে আমাদের বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এই ম্যাপ সহজেই সুইজারল্যান্ড থেকে কিনে আনে, যেটা তাদের জন্য বেশি সুবিধাজনক ছিল।
নব্বইয়ের দশকে এসে এ রকম নির্মাণকাজে নতুনভাবে যোগ হয় জিপিএস সিস্টেম। নদীশাসনের সময় আমরা নদীর পাড়ে যে পাথর বসাই, সেগুলো কিন্তু সম্পূর্ণভাবে জিপিএস দিয়ে হিসাব করে বসানো হয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে নদীশাসনের সময় ও সেতুর পাইলিংয়ের কাজেও জিপিএস ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া সেতুর ডিজাইনের সময় আমাদের নদীর গতিপথ পরিবর্তনের চিত্র স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে বানানো হয়েছে।
জিও টেক্সটাইল বস্তাও এখনকার সময়ের নতুন প্রযুক্তি। সিনথেটিক বস্তায় বালু ভরে ভারী পাথরের মতো বানানো হয়। এখানে সর্বোচ্চ আমরা ৮০০ কিলোগ্রাম ওজনের বস্তা ব্যবহার করি। সেগুলো কিন্তু আমাদের দেশেই তৈরি করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে নদীশাসনে ব্যবহৃত পাথরগুলো আনা হয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে। পদ্মা সেতুতেও আমরা পাথর ব্যবহার করছি প্রায় ১ টন ওজনের। যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছিল মাত্র ১০০ কিলোগ্রামের। পদ্মা নদীর স্রোত বেশি হওয়াও এখানে বেশি ভারী পাথরের দরকার পড়ছে।