ঢাকা | ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪ - ২:২৩ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনামঃ

মানুষকে মানুষের পাশে আনছে যে মহামারি

  • দৈনিক নবোদয় ডট কম
  • আপডেট: Thursday, December 10, 2020 - 2:24 pm
  • admin
  • পঠিত হয়েছে: 124 বার

২০২০ সালের ১২ মার্চ লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন ‘করোনাভাইরাস বিস্তারের কালে বৈষম্য ও বর্ণবাদ’ নামে এক আলোচনার আয়োজন করে। সেই সভায় হ্যাকনি কমিউনিটি সার্ভিসের ব্যবস্থাপক জ্যাবেজ ল্যাম উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ২৩ জানুয়ারি চীনের উহান শহরে লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর থেকে তাঁর সংস্থা লন্ডননিবাসী চীনা ও পূর্ব এশীয়দের কাছ থেকে নিপীড়িত হওয়ার খবর পাচ্ছে। সেই থেকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশে চীনা বংশোদ্ভূত মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, কর্মস্থল ইত্যাদি স্থানে বৈষম্যমূলক মনোভাব ও আচরণের শিকার হয়েছেন। শারীরিক আক্রমণ থেকে শুরু করে মানসিক হয়রানি সহ্য করতে হয়েছে তাঁদের। অনেকে চীনাদের কোভিড-১৯ রোগের সঙ্গে যুক্ত করে তাঁদের মহামারি বিস্তারে দায়ী করেছেন।
মহামারির সময়ে বৈষম্যের ঘটনা নতুন কিছু না। বহুকাল যাবৎ এইচআইভি সংক্রমণে সমকামী সম্প্রদায়কে দায়ী করা হতো। দশকের পর দশক ধরে প্রচারণা চালিয়ে তবেই ভুল ধারণাগুলো নিরসন করা গেছে। চাকরি, ভ্রমণ, বিমা, অভিবাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এইচআইভিতে আক্রান্ত মানুষের নানা অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০০০ সালে আমি যখন প্রথম এইচআইভি নিয়ে এক গবেষণা প্রকল্পে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাই, পরিচিতদের অনেকে ভয়ে ছিল, পাছে আমি না সংক্রমিত হই। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনেকে নাকি ইচ্ছা করে অন্যদের এইচআইভিতে সংক্রমিত করে, এই গুজবটিই ছিল ভয়ের কারণ।
সার্স মহামারির সময়েও চীনাদের সংক্রমণের উৎস বলে মনে করা হয়েছিল। আবার ইবোলা সংকটের সময়ে আফ্রিকানদের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়। প্রতি মহামারির সময়েই লোকে ‘অপর’ কোনো গোষ্ঠীকে রোগের ‘কারণ’ হিসাবে দায়ী করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশে কিছু এলাকায় লোকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার হাসপাতাল স্থাপনে বাধা দিয়েছে। শুরুর দিকে স্বাস্থ্যকর্মী ও কোভিড-১৯ রোগীদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। অনেকে কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার খবর ভীতির কারণে লুকিয়েছেন। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

জনস্বাস্থ্য সংকটের সময়ে আমরা বৈষম্য নিয়ে ভাবব কেন? প্রথমত, এটা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। এর পাশাপাশি বৈষম্য সংক্রান্ত ভয়ের কারণে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা এবং চিকিৎসা নিতে অনেকের মাঝেই অনীহা দেখা যায়। এতে রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়। এইডস মহামারির প্রথম পর্যায়ে জোনাথন মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এইডস বিষয়ক বৈশ্বিক কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যাখ্যা করেন, যেসব গোষ্ঠী প্রান্তিক অবস্থানে আছে এবং বৈষম্যের শিকার (যথা সমকামী, সুচের দ্বারা মাদকসেবী, যৌনকর্মী প্রমুখ) তারাই এইচআইভি সংক্রমণের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকিতে ছিল। আবার সংক্রমণের পর তারা আরও বেশি প্রান্তিক হয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ সহ অনেক মহামারির ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি প্রযোজ্য। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও নানা দেশে কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুরা মাত্রাতিরিক্ত হারে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে তারা যে অবিচার, বর্ণবাদ ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, তার সঙ্গে এই আক্রান্ত হওয়ার যোগ আছে বলা যায়।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে আর্থসামাজিক অবস্থার যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। তবে মহামারির নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। মহামারির সময় মৃত্যু এবং অনিশ্চয়তাজনিত ভীতির মুখে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ নিজের সামাজিক বৃত্তের বাইরের কাউকে দায়ী করে ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করে। জনস্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থার সময় যেভাবে গণমাধ্যম ঘটনাটিকে উপস্থাপন করে তা জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সবাইকে যা ইচ্ছা তা প্রকাশ করার সুযোগ দিয়েছে। ফলে বহুক্ষেত্রে ভুল তথ্য ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ সহ যেকোনো সংকটে প্রতিটি ব্যক্তি নিজের পছন্দের খবরেই বিশ্বাস রাখছে ও তা শেয়ার করছে। অনেকেরই বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আগে থেকে নানা রকম সংস্কার রয়েছে, যা দুর্যোগের মুহূর্তে ফুলেফেঁপে ওঠে। ফলে বর্ণবাদ, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ও বৈষম্যের বিস্তার ঘটে।
মহামারিকালে বৈষম্যের সমস্যাটির গুরুত্ব নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে। বিভিন্নভাবে ছড়াতে থাকা নানা গুজব ও ভ্রান্ত তথ্য নাকচ করা, উপযুক্ত জনস্বাস্থ্য যোগাযোগ কৌশল তৈরি, এবং গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। বিষয়টি উপস্থাপনে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক নাগরিককেও সচেতন হতে হবে। ভুয়া খবরে বিশ্বাস বা প্রচার করা যাবে না। সবাইকে গণমাধ্যম-শিক্ষিত হয়ে অহেতুক ভয়ভীতি এড়াতে বিজ্ঞানসম্মত তথ্য পাওয়ার নির্ভরযোগ্য সূত্র শনাক্ত করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

কোভিড-১৯ প্রত্যেক সমাজে বিরাজমান সমস্যাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শুরু করে ঘরের মাঝে কাজের বণ্টন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়েই আমরা নতুন করে ভাবছি। তবে আমাদের সমাজে দৈনন্দিন জীবনে নানা গোষ্ঠীর প্রতি যে বৈষম্যমূলক মনোভাব রয়েছে তা ভুলে গেলে চলবে না। কাজের সুবাদে আমি এমন অনেক পরিবারের দেখা পেয়েছি যারা প্রতিবেশীদের কটু কথা শোনার ভয়ে বছরের পর বছর প্রতিবন্ধী শিশুকে বাড়ির ভেতরে লুকিয়ে রেখেছেন। মানসিক রোগী, আদিবাসী, শরণার্থী এমনকি আঞ্চলিক উচ্চারণ নিয়ে ঠাট্টা ও অসংবেদনশীল মন্তব্য আমরা কে না শুনেছি?
সমাজে সকল নারী-পুরুষ-শিশু যেন নিজ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারে তার জন্য যথাযথ আইনি ও নীতিগত কাঠামো থাকা এবং তার বাস্তবায়ন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে সেই সঙ্গে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। দরকার প্রত্যেকটি মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শেখা, তা তাদের পরিচয় যাই হোক না কেন। দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের পরিবর্তন হলে আমরা এমন এক সমাজ গঠন করতে পারব যেখানে প্রত্যেক মানুষ মর্যাদা নিয়ে বাঁচবে।

কোভিড-১৯ এর সময়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা যেমন দারুণ বিপন্ন বোধ করেছি, তেমনি আবার মানবিক স্তরে আমরা সবাই যে সমান সেটি মনে পড়ে গেছে। ‘মানুষ বড় কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’-কবির বাণী যেন অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছে। নিখাদ সহমর্মিতা ও মানবিকতার প্রকাশ দেখে আমরা আশাবাদী হয়েছি। এই যৌথ অভিজ্ঞতার ফলে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশে কী পরিবর্তন আসবে তা বুঝতে সময় লাগবে। আরও ন্যায্য, সবুজ, সমতা এবং ন্যায়বিচারভিত্তিক বিশ্বের সৃষ্টি হবে কিনা তা নির্ভর করবে বিভিন্ন দেশের সামষ্টিক আর্থসামাজিক নীতি এবং বিনিয়োগে অগ্রাধিকার নির্ধারণের ওপর। আমরা কি পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা লালন করব? আরেকটু বিজ্ঞানমনস্ক এবং সংবেদনশীল হব এবং সবার অধিকার রক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠব? সবার জন্য বাসযোগ্য একটি সমাজের সূচনায় আমরা কি আন্তরিক?