দুর্নীতির রাশ টানা
গতকাল ছিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি–করাপশন ডে বা আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। এ বছর এ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে ‘রিকভারি উইথ ইনটেগ্রিটি’ বা সততার সঙ্গে উত্তরণ। বলা বাহুল্য, এটা বিশ্বজুড়ে চলমান কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলার কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব আরোপ; আমাদের দুর্নীতি লাঘবের মধ্য দিয়ে এ সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতে হবে।
মহামারিকালে জীবন সংশয় ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সঙ্গে সঙ্গে যে নৈতিকতারও সংকট দেখা দিতে পারে, তা আমরা বাংলাদেশে বিশেষভাবে লক্ষ করলাম। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের নৈতিক দেউলিয়াত্ব এ মহামারিকালে বড়ই ন্যক্কারজনকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। সরকারের দেওয়া প্রণোদনা, ত্রাণ কার্যক্রম, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম ইত্যাদি ক্রয় ও বিতরণসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম, দায়িত্বহীনতার যেসব দৃষ্টান্ত দেখা গেছে, তাতে দুর্নীতির অন্য ক্ষেত্রগুলোর দিক থেকে জাতির দৃষ্টান্ত সরে গেছে। মার্চ মাসে কোভিড–১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত দেশজুড়ে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের চাঞ্চল্য। বছরের শুরুতেই আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করেছিল, অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে যেসব ব্যক্তি বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়েছেন, বিদেশে পাচার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান অব্যাহত থাকবে, চুনোপুঁটি থেকে শুরু করে রুই–কাতলা পর্যন্ত কেউই ছাড় পাবেন না।
বিজ্ঞাপন
আমরা জানতে পারলাম, দুদক তার কথা অনুযায়ী অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করল, অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করল, অনেকের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। এ তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সাংসদ এবং নেতাও ছিলেন। কিন্তু কোভিড–১৯ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান থেমে গেল, এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দুদক যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছিল, তাঁরা জনদৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার সুযোগ পেলেন; তাঁদের সম্পর্কে ফাইলগুলো দুদকের তাকে তাকে চাপা পড়ে গেল।
গতকাল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন উপপরিচালকের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, কোভিড–১৯ মহামারিকালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির ইস্যুগুলো সামনে চলে আসায় দুদক তার ‘ফোকাস’ বা মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন করে। এভাবে যখনই একটা নতুন ইস্যু সামনে চলে আসে, তখন দুদককে সেই ইস্যুতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়, ফলে আগের কাজগুলো পেছনে পড়ে যায়, এভাবে কোনো ইস্যুতেই বেশি অগ্রগতি ঘটে না। ফলে দুদকের টেবিলে টেবিলে ফাইলের স্তূপ জমে ওঠে।
প্রশ্ন হলো, দুদককে কেন চলমান কাজগুলো অনিষ্পন্ন রেখে নতুন নতুন চাঞ্চল্যকর ইস্যুর পেছনে ছুটতে হয়? আসলে কি দুদক স্বাধীনভাবে নিজেদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্ব পালন করে বা করতে পারে? নাকি সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ইচ্ছা–অনিচ্ছার দ্বারাই দুদকের দুর্নীতিবিরোধী তৎপরতার গতিবিধি ও স্বরূপ নির্ধারিত হয়? এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেছেন, দুদক নিজের জন্য একটি বিভাজনরেখা তৈরি করে নিয়েছে, যেটার বাইরে সে যেতে চায় না, যেতে পারে না বা যেতে ভয় পায়। দুদক কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বা নেবে না, তা নির্ভর করে সেই ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের ওপর।
অর্থাৎ দুদকের দুর্নীতিবিরোধী তৎপরতা যেটুকু দৃশ্যমান, তা সিলেক্টিভ বা বাছাইকৃত। জাতীয় এ প্রতিষ্ঠান যত দিন পর্যন্ত না এ অবস্থান থেকে বেরোতে পারছে, তত দিন সে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে ও জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী পালন করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দুদক কীভাবে তার বাছাইকরণের অবস্থান ত্যাগ করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতির সব ক্ষেত্রে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করবে।