গল্প “তিন বন্ধুর বিজয় উদযাপন”
ছোট্ট একটি গ্রামে থাকত তিন বন্ধু—তন্ময়, রানা আর নিধি। বয়সে ছোট হলেও তাদের মন ছিল বড়। একসঙ্গে খেলাধুলা, পড়াশোনা আর মজার মজার গল্পে তাদের দিন কেটে যেত। ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবস, তাদের জন্য ছিল এক বিশেষ দিন। কিন্তু এবছর স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান না হওয়ার খবর পেয়ে তিনজনেই মন খারাপ করল।
তন্ময় বলল, “এভাবে তো বিজয় দিবস উদযাপন হতে পারে না! এ দিনটা আমাদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ!” রানা হালকা হাসি দিয়ে বলল, “তা ঠিক। কিন্তু আমরা কী করব? আমাদের তো কোনো আয়োজন করার মতো টাকা-পয়সা নেই।” নিধি দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “টাকা না থাকলেও আমরা আমাদের ইচ্ছা দিয়ে কিছু করতে পারি। বিজয় দিবস উদযাপনের দায়িত্ব এবার আমরা নিজেরাই নেব।”
তিন বন্ধু মিলে পরদিন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করল। বিজয় দিবস উপলক্ষে কী কী করা যায় তা নিয়ে তারা এক জায়গায় বসে আলোচনা করল। সিদ্ধান্ত হলো, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, আর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের গল্প শোনানোর আয়োজন করবে তারা।
তন্ময় বলল, “আমাদের স্কুলে একটা পুরোনো জাতীয় পতাকা আছে। সেটা ব্যবহার করা যেতে পারে।” রানা বলল, “আমি বাবার কাছ থেকে বাঁশ এনে দেবো। সেটা দিয়েই আমরা পতাকা উড়াবো।” নিধি উত্তেজিত হয়ে বলল, “আমি আমাদের গান শেখানোর স্যারকে ডেকে আনব। উনি আমাদের জাতীয় সংগীত গাইতে সাহায্য করবেন।”
গ্রামের মাঠকে তারা অনুষ্ঠানের জন্য বেছে নিল। রানা আর তন্ময় মিলে মাঠ পরিষ্কার করল। গ্রামের মুদির দোকানদার কাকা তাদের কিছু রঙ আর কাগজ দিলেন, যা দিয়ে নিধি চিত্রাঙ্কনের জায়গা সাজিয়ে তুলল।
১৬ই ডিসেম্বর সকালে গ্রামে শুরু হলো নতুন উদ্যমে বিজয় দিবস উদযাপন। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। গ্রামের সবাই দাঁড়িয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাইল। নিধি সুরে নেতৃত্ব দিল, আর তন্ময় খুঁটির কাছে দাঁড়িয়ে পতাকাকে সঠিকভাবে উড়ানোর দায়িত্ব নিল।
এরপর গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধা চাচা তাদের যুদ্ধের দিনগুলোর গল্প শোনালেন। তাঁর কণ্ঠে সাহস আর গর্বের ছোঁয়া ছিল। তিনি বললেন, “আমরা এই দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম। তোমাদের মতো শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম দেখে আমি আজ আশাবাদী।”
চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় গ্রামের শিশুরা একের পর এক মনোমুগ্ধকর ছবি আঁকল। কেউ আঁকল জাতীয় পতাকা, কেউ মুক্তিযোদ্ধার ছবি। প্রতিযোগিতার শেষে কবিতা আবৃত্তি হলো, যেখানে নিধি আর রানা বিজয়ের গল্প নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করল।
সন্ধ্যার দিকে তিন বন্ধু মিলে একটি ছোট নাটক পরিবেশন করল। নাটকের নাম ছিল “স্বাধীনতার গল্প,” যেখানে তারা দেখাল কীভাবে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাদের দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিল। নাটকের শেষে গ্রামের সবাই মুগ্ধ হয়ে তাদের করতালি দিল।
অনুষ্ঠান শেষে এক প্রবীণ দাদা বললেন, “তোমরা যে কাজটা করলে, তা শুধু তোমাদের নয়, পুরো গ্রামের গর্ব। তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ সঠিক হাতে আছে।”
তিন বন্ধু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারা বুঝল, উদ্যোগ আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে কোনো কাজ সম্ভব। তাদের এই ছোট আয়োজন শুধু বিজয় দিবস উদযাপন নয়, বরং তাদের দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হয়ে রইল।
সেদিনের পর থেকে তিন বন্ধু ঠিক করল, তারা প্রতিবার নিজেরাই এমন উদ্যোগ নেবে এবং দেশের গৌরবগাঁথা সবসময় অন্যদের মনে করিয়ে দেবে। তাদের চোখে সেদিনের বিজয় দিবস শুধুই এক অনুষ্ঠান নয়; বরং তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়ে রইল।
(০২)
লাল সবুজের গল্পকথা
-বিচিত্র কুমার
সোনালীপুর গ্রামটি সবুজ শ্যামল প্রকৃতির মাঝে ঘেরা। ধানক্ষেত, শিমুলগাছ আর বয়ে চলা ছোট্ট নদী যেন বাংলাদেশের পতাকার রূপক। ডিসেম্বর মাস এলে গ্রামটি যেন এক অন্য রঙে রাঙা হয়ে ওঠে। এই সময় বড়রা বিজয় দিবস উদযাপনের নানা আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে শিশুরাও পিছিয়ে থাকে না। তারা নিজেদের মতো করে বিজয়ের গল্প তুলে ধরতে চায়।
সজল, তানিয়া ও রাসেল—তিন বন্ধু। তারা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। বিজয় দিবসের জন্য বিশেষ কিছু করার পরিকল্পনা করছিল। সজল একদিন বলল, “চলো, এবারের বিজয় দিবসে আমরা একটা নাটক করি। সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়ে দেখাই, আমাদের বিজয় কতটা গৌরবের।”
তানিয়া উত্তেজিত হয়ে বলল, “তাহলে দাদুভাইয়ের কাছে যাই। তিনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার কাছে শোনা গল্প দিয়েই আমরা নাটক সাজাব।”
তিনজন ছুটে গেল তানিয়ার দাদুভাই আবদুল হকের কাছে। তিনি তখন বাগানে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। সজল বলল, “দাদুভাই, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলুন। আমরা সেটা দিয়ে নাটক করব।”
দাদুভাই হাসলেন। বললেন, “মুক্তিযুদ্ধ কোনো সাধারণ গল্প নয়। এটি ত্যাগ, সাহস আর ভালোবাসার গল্প। শোনো, আমি তোমাদের একটা ঘটনা বলি।”
তিনি গল্প বলতে শুরু করলেন।
“১৯৭১ সালের শীতের এক রাতে খবর এলো, পাকিস্তানি সেনারা পাশের গ্রামে আক্রমণ করেছে। আমরা, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রামটিকে রক্ষা করতে হবে। ভয় তো ছিলই, কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা আমাদের সাহস জুগিয়েছিল। অন্ধকার রাতে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালালাম। সেই যুদ্ধে আমরা জয়ী হলাম। কিন্তু অনেক জীবন দিতে হয়েছে। এই জীবনগুলোর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। পতাকার লাল রঙ শহীদদের রক্তের প্রতীক, আর সবুজ রঙ আশা আর নতুন জীবনের।”
তিন বন্ধুর চোখ তখন অশ্রুসিক্ত। সজল বলল, “এই গল্প দিয়েই আমরা নাটক সাজাব। সবাইকে জানাতে হবে, আমাদের বিজয় কতটা মূল্যবান।”
তারা স্কুলে ফিরে গেল। জাহানারা ম্যাডাম তাদের পরিকল্পনা শুনে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, “তোমরা যদি এমন একটি নাটক মঞ্চস্থ করো, তাহলে গ্রামের সবাই মুক্তিযুদ্ধের গল্প আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে।”
নাটকের প্রস্তুতি শুরু হলো। তানিয়া মুক্তিযোদ্ধার মা, সজল মুক্তিযোদ্ধা আর রাসেল হলো এক গ্রামের ছেলে। নাটকে তুলে ধরা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম আর গ্রামবাসীর সহযোগিতা। নাটকের শেষে দেখা গেল, সবাই মিলে দেশের পতাকা উঁচু করে ধরে আছে আর বিজয়ের গান গাইছে—“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।”
১৬ ডিসেম্বর। গ্রামজুড়ে বিজয় দিবস উদযাপনের উত্তেজনা। বিদ্যালয়ের মাঠে বড় মঞ্চ বানানো হয়েছে। চারপাশে লাল সবুজের পতাকা উড়ছে। সবার মাঝে এক অদ্ভুত আনন্দ।
নাটক শুরু হলো। শিশুরা একেবারে প্রাণ ঢেলে অভিনয় করল। তাদের চোখ-মুখে ছিল গর্ব আর দেশপ্রেমের দীপ্তি। গল্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর বিজয়ের চিত্র দেখে দর্শকরা আবেগে ভেসে গেল।
দাদুভাই আবদুল হক সামনে বসে ছিলেন। নাটক শেষ হলে চোখের জল মুছে বললেন, “তোমাদের মতো শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। মুক্তিযুদ্ধের গল্প যদি তোমরা ধরে রাখো, তাহলে বাংলাদেশ চিরদিন তার গৌরব ধরে রাখবে।”
গ্রামের সবাই হাততালি দিয়ে এই কথায় সম্মতি জানাল। জাহানারা ম্যাডাম বললেন, “আজকের নাটক আমাদের শেখাল, লাল সবুজের এই পতাকার পেছনে কত ত্যাগ আর সংগ্রামের গল্প লুকিয়ে আছে। আমাদের দায়িত্ব, এই স্বাধীনতার মূল্য বুঝে দেশকে ভালোবাসা।”
সেদিন শুধু সোনালীপুর নয়, পুরো বাংলাদেশের আকাশে বিজয়ের নতুন আলো ছড়িয়ে পড়ল। শিশুদের মনে জন্ম নিল দেশপ্রেমের নতুন বীজ। তারা প্রতিজ্ঞা করল, তারা ভালো কাজ দিয়ে সবসময় দেশের গৌরব রক্ষা করবে।
লাল সবুজের পতাকা উড়তে থাকল। সেই পতাকা যেন বলতে লাগল, “আমি তোমাদের গৌরব, আমি তোমাদের পরিচয়। আমাকে রক্ষা করাই তোমাদের দায়িত্ব।”
(০৩)
মুক্তির জোনাকি আলো
-বিচিত্র কুমার
ছোট্ট গ্রামটির নাম ছিল সোনাঝুরি। সেখানে খোকা নামে এক দশ বছরের ছেলে থাকত। খোকার দিন কাটত গল্প শুনে আর স্বপ্ন দেখে। তার প্রিয় ছিল দাদার মুক্তিযুদ্ধের গল্প। দাদা বলতেন, “সেই দিনগুলো ছিল একদম অন্ধকার। তবে সেই অন্ধকার ভেদ করেই এসেছিল মুক্তির আলো।” খোকা প্রতিবার এই কথা শুনে ভাবত, মুক্তির আলো কেমন ছিল?
একদিন খোকা জানতে পারল, পরদিন স্কুলে বিজয় দিবস উদযাপন হবে। সেখানে নাটক, গান আর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। খোকার মন ছটফট করতে লাগল। সে চাইল, এমন কিছু করতে যাতে সবাই বিস্মিত হয়। কিন্তু কী করবে, সেটা বুঝে উঠতে পারছিল না।
সন্ধ্যায় খোকা বাগানে বসে ছিল। হঠাৎই সে দেখতে পেল, ঘাসের ওপর অনেক জোনাকি পোকা আলো জ্বালাচ্ছে। ছোট ছোট আলো মিলে যেন একটা তারার মেলা। খোকার মনে হঠাৎই একটা আইডিয়া এলো। সে ভাবল, “এই জোনাকিদের আলো দিয়ে আমি মুক্তির বার্তা তৈরি করব।”
খোকা দেরি না করে তার বন্ধুদের ডাকল। সে তাদের বলল, “তোমরা জানো, জোনাকি পোকারা অন্ধকার রাতে আলো জ্বালায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও ছিল অন্ধকার ভেদ করে আলো আনার গল্প। আমরা এই জোনাকিদের সাহায্যে একটি বিশেষ বার্তা বানাব।”
সবাই মিলে পরিকল্পনা শুরু করল। তারা বাড়ি থেকে কাঁচের জার আনল। এরপর রাতভর জোনাকি পোকা ধরতে শুরু করল। অনেক জোনাকি পোকা ধরে তারা সেগুলোকে যত্ন করে জারের ভেতর রাখল। খোকা মাটি দিয়ে বড় অক্ষরে “মুক্তি” লিখল। এরপর প্রতিটি অক্ষরের ওপর আলাদা আলাদা জোনাকির জার সাজিয়ে রাখল।
বিজয় দিবসের সকালে পুরো গ্রাম সেজে উঠল লাল-সবুজের পতাকায়। স্কুলে অনুষ্ঠান শুরু হলো। গান, কবিতা আর নাটকে সবাই মুগ্ধ। কিন্তু খোকার তৈরি বার্তা দেখে সবাই থমকে গেল। জোনাকির আলোয় লেখা ‘মুক্তি’ যেন এক জ্যান্ত প্রতীক হয়ে উঠল।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মঞ্চে উঠে বললেন, “খোকা আর তার বন্ধুরা আজ আমাদের বড় একটি শিক্ষা দিল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে যে যতই অন্ধকার আসুক, আলো জ্বালাতে কেউ না কেউ থাকবে। এই জোনাকির আলো সেই আলোর কথাই মনে করিয়ে দিল।”
খোকার গর্বে বুক ভরে গেল। কিন্তু তার মনে হলো, কাজ এখনও বাকি। বিজয় দিবসের শিক্ষা তাকে মনে করিয়ে দিল, মুক্তির আলো শুধু উদযাপনের নয়, সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার।
সেদিনের পর থেকে খোকা আরও বেশি স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। সে ঠিক করল, বড় হয়ে এমন একজন হবে, যার কাজ মানুষকে আলো দেখানো।
মুক্তির জোনাকি আলো তাই শুধু একটি প্রদর্শনী ছিল না; ছিল খোকার মতো নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার এক ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস।
কবি ও লেখক
– বিচিত্র কুমার