‘একটি শোকবার্তা ও কিছু কথা’
এবিএম সালেহ উদ্দীন : আশাছিল তিনি ফিরে আসবেন । কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তিনি ফিরে আসলেন না । মানুষটির নাম তপন বড়ুয়া । ভয়ংকর মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ একমাস ‘এলেন হাসপাতালে’অজ্ঞান থাকার পর ২২ ডিসেম্বর,২০২০.মঙ্গলবার শেষরাতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের জন্য চলে গেলেন । আমার সহধর্মিনী রেজভীন প্রতিদিনই তার পরিবারের মাধ্যমে খবর নেয়ার চেষ্টা করেছেন ।
আহা! ঘরে অসুস্থ স্ত্রী, একমাত্র ছেলেকে রেখে গেছেন । ছেলেটি মেডিকেল পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল । কী করুণ ! কতটা হৃদয় বিদারক ও অনাকাঙ্খিত !
সকালবেলায় অপ্রত্যাশিত খবরটি শুনে হৃদয়টা ভেঙে গ্যাছে । আমি স্তম্ভিত হতচ্যুত হয়ে গেছি । এমন প্রাণবন্ত হাস্যময় মানুষটি কেউকে না জানিয়ে সবাইকে কাঁদিয়ে শেষ পর্যন্ত যাবেন(?)ভাবতেই শিউড়ে উঠি । মানুষ ত এমনই যখন চলে যায় ;কতজনের বুকে কত বিমুগ্ধ স্মৃতির পাহাড় চাপিয়ে মহাপ্রয়াণ ঘটে ! কত বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যায় । তেমনই প্রিয় ছিলেন মানুষ তপন বড়ুয়া ।
কতটা বিমর্ষকাতর ও বেদনাহত হয়েছি এবং কষ্ট পেয়েছি তা বুঝানোর ভাষা জানা নেই । তার রেখে যাওয়া পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি ।
আমি ম্যানহাটনে বিশ বছর ছিলাম । তন্মধ্যে একই বিল্ডিং-এ কেটেছে ১৮ বছর । বিরাট এপার্টম্যান্ট কম্পেলেক্স-এর অন্যপ্রান্তের নিচতলায় তিনি স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রসহ থাকতেন । কখনো দেখলেই ছুটে আসতেন কাছে । সম্বোধন করতেন;আদাব দাদা!
কত স্মৃতি ! যাদের কাছে আমার আশা থাকত,তাদের ডিঙিয়ে কোথা থেকে এসে, এই ভদ্রলোক যেন মনের মধ্যে একটি স্থায়ী আসন করে নিলেন । আমার পরিবারের স্মৃতিকাননেও মিশে থাকলেন । বিশেষকরে,কয়েকবছর আগে প্রয়াত: আমার আরেক প্রিয় মানুষ মানববন্ধু ‘রতন বড়ুয়া’ যাঁর আমাদের বাসায় বেশ যাতায়াত ছিল । সেসময় তিনি তার বাসায়ও যেতেন ।
ছয় বছর হল, আমরা কুইন্স ভিলেজ চলে এসেছি । তপন দা বহুবার এই বাসাটিতেও এসেছেন । আমাদের অনেক ঘরোয়া পার্টিতেও তাকে এবং পরিবারকে খুব আপনরূপে পেয়েছি । আমাদের জিনিসপত্র আনা-নেয়ার ক্ষেত্রেও তদারকি করেছেন,হেল্প করছেন । কখনো দেখা হলে , দাদা বলে,আগ বাড়িয়ে আসতেন । সাধারণ্যের মাঝেও অসাধারণ গুণ ।
সত্যিই, আমার জানা মতে, তিনি একজন বিনয়াবনত সমাজ সচেতন ভালো মানুষ । বৌদ্যিস্ট কম্যুনিতেও তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন । এই কম্যুনিটি’র স্বনামধন্য বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সমাজ সেবক মি: চিত্ত সিংহ, যিনি আমার দীর্ঘদিনের আরেক প্রিয় মানুষ ।
তিনিও জানালেন, তপন দা ছিলেন একজন পরপোকারি অত্যন্ত ভালো মানুষ । দেশে যেতেন তার গাড়িটি আমাদের ব্যাকইয়ার্ডে রেখে যেতেন । স্ব-উদ্যোগি হয়ে আমরাও আগের এলাকায় গেলে তার বাসায় যাওয়াটাও যেন আমাদের রুটিনে ছিল । আমার এই ক্ষুদ্রজীবনে কত জ্ঞানী, গুণি বিশাল মানুষের সাক্ষাৎ ঘটল । তবু কেন তার কথাটি পূনরাবৃত্তি করি ; কেননা তিনিও আমার কাছে একজন ভালো মানুষ । পৃথিবীতে তিনও সজ্জন ও অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন ।এই সহজ ও সরলভাবে জীবনযাপনকারী সদা হাস্যজ্জ্বল মানুষটি কিভাবে সবার সাথে এত আপনরূপে মিশে গিয়েছিলেন , যা কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয় । তিনি চির বিদায়ের মধ্যদিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, মৃত্যু হচ্ছে মহাজীবনের মহাযাত্রা ।
তাই ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন—
“কোথা হতে আসিয়াছি,নাহি পড়ে মনে
অগণ্য যাত্রীর সাথে তীর্থদরশনে”
আরেকটি কবিতায়—
দীপাবলী নিবাইয়া চলে যাবে যবে”
নানা পথে নানা ঘরে পূজকেরা সবে
দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে, শান্ত অন্ধকার ।”
প্রত্যেকটি বিদায় মৃত্যুর পদধ্বনি বাজিয়ে যায় । কত কথা কত স্মৃতির গাঁথামালা ছিন্ন হয়ে পড়ে পড়ে থাকে বিচ্ছেদেরই পরম্পরায় । রেখে যায় অফুরন্ত তৃষ্ণা ।
তেমনই কাজী নজরুল ইসলাম বলেন—
“ছাড়িতে পরাণ নাহি চায়
তবু যেতে হবে হায়
মলয়া মিনতি করে
তব কুসুম শুকায়”।
—————-🌹♥️🌹
তার পরমাত্মা শান্তিতে থাকুক । ভালো থাকুন তপন দা ।