#গল্প#- নাকের বাঁশি
# লেখক- শরীফ শামিল
উৎসর্গঃ[ প্রিয় ভাজন কবি Shafiq Ismail Miahকে]
তিনজন যুবক। একজন ভারতীয়, অন্যজন নেপালি আরেকজন বাংলাদেশি। একই অভিযোগ পেশ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
জেদ্দা শহরের রয়েল কমিশন( কন্সট্রাকশন কোম্পানির) এম. ডি. ( মিশরীয়) সাহেব বসে আছেন , তাঁর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুমে।
প্রথমে বাংলাদেশি যুবকটি তার রুজু খাড়া করল এভাবেঃ স্যার, নোজ কাতির সাউণ্ড।
মিশরীয় এম ডি কিছু বুঝে ওঠার আগেই এগিয়ে আসে ভারতীয় যুবক ঃ স্যার, খাড়াঠা মুশকিল..
এম ডি সাহেব এবার নেপালি যুবকের দিকে তাকান। নেপালি , যুবক তখন নিজ নাকে হাত ঠেকিয়ে অভিনয়ের ভঙ্গিতে দেখায়; তৎসঙ্গে মুখও চালায় – স্যার, কাতিকুনি বাজাতাহে…
আসল সমস্যা/ অভিযোগটা তখনো ধরতে পারেন না, মিশরীয় এম ডি মহোদয়। তাঁর চোখেমুখে বিস্ময়।
অভিযোগকারিদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশি ফোরম্যান। ভেতরে ভেতরে সে অভিমানি হয়ে আছে– অভিযোগকারিদের উপর। অনেকটা সেরকম– ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেয়ে ফেলেছে যেন অভিযোগকারিরা। তবু হাসি হাসিমুখ করে ফোরম্যান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে থাকল– এমনসুরে কথা বলছিল সে যেন মনে হচ্ছিল বিশেষ কোনো গোমর ফাঁস করছিল।
বিল্ডিং কোম্পানির লেবাররুমগুলো দেখতে অনেক টা হাসপাতালের রোগীর ঘরদের মতো বা ট্রেন কামরার দুতলা বাঙ্কারের মতো। প্রতিটি রুমের নিচ- উপরের সারি মিলে ১২/ ১৪ টি খাট থাকে। প্রতি খাটে দুজন করে নির্মাণশ্রমিক ঘুমায়। কোনো বিছানায় একই দেশের দুজন ঘুমায় আবার কোনো বিছানায় দুদেশের দূজন শ্রমিক ঘুমায়। শোয়া বা ঘুমানো নিয়ে কোনো সমস্যা নাই;( দুনিয়ার শ্রমিক এক হওয়ার মতো তারাও এক হয়ে থাকে) কিন্তু সমস্যা হচ্ছেঃ প্রতিটি রুমেই দুতিনজন শ্রমিক নাক ডেকে ঘুমায়!
কারো কারো নাক ডাকার মাঝে সুর ছন্দের একটা ব্যাপার স্যাপার থাকে কিন্তু এদের শাঁস রস কিছুই নেই। তারা নাক ডাকায় না, যেন জেনারেটর চালু করে দেয়। যন্ত্র – জেনারেটর এর শব্দ। তাও সহা যায় কিন্তু জন্তু- জেনারেটর এর শব্দ। অসহ্য। ওই বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে,, দ্বিতীয় বার ঘুমানো কঠিন হয়ে পড়ে। এতো নিজ পেট খালি করার জন্য ঘুম ভাঙা নয়যে, কাজ সেরে আরাম করে আবার ঘুমিয়ে পড়া যাবে।
তো এম ডি সাহেব এসব বৃত্তান্ত শুনতে শুনতেই দু একটা উপায় বাতলে দিতে থাকেনঃ ওরা যখন নাক ডাকায়, তখন ধাক্কা টাক্কা দিয়ে – ওদেরকে সচেতন করতে হবে।
অভিযোগকারি তিনজন যুবক তখন, একে একে তাদের সমস্ত কৌশল ব্যর্থ হবার কাহিনি বর্ণ না করে শোনায়। খাটের স্ট্যাণ্ডে কীভাবে তারা লোহার এস। সাইজের আংটা বাধিয়ে রাখে ( দড়ির সাহায্যে), আর নাকডাকা শুরু হওয়ামাত্রই ওই দড়িতে টান দেয়..
কীভাবে ওপরের বিছানায় শুয়ে থাকা শ্রমিকরা, নিচের নাকডাকাদেরকে লাথি গুত্তা মারে, জগ গ্লাস থেকে পানির ছিটা ঝাপটা মারে, এমনকী বিছানা থেকে মেঝেতে ফেলেও দেয়…। কিন্তু যেই আনি সেই পাই…
কেউ কেউ সহ্যসীমার উর্ধ্বে উঠে, বাইরে বাথরুমের সামনে বস্তা বিছিয়ে শোয়। কেউ আবার না ঘুমিয়েই কাটায় সারারাত। অথচ খুবভোরে ওঠেই কাজে যোগদান করতে হয় তাদেরকে।
তাদের এখন ক্ষুদামন্দা চলছে– নষ্টঘুমের কারণে। এভাবে তারা আর বাঁচবে কতদিন? একজনতো তার দেশের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছে, আমাকে মাফ করে দিও, আমি আর বেশিদিন নাই এজগতে। তোমরা বাঁশের বাঁশি শুনেছো কিন্তু নাকের বাঁশি কি শুনেছো? এসব শুনে কথা শুনেতো তার স্ত্রী বেচারি কেঁদেকেটে হয়রান হচ্ছে, হরদম। লোকটা এসব কী বলছে উল্টাপাল্টা! ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি- গরম দেশে যাইয়া?
এ পর্যন্ত শুনে এমডি সাহেব হাত তুলে ওদেরকে থামান।এবং গত পরশু একজন শ্রমিকের কার্ণিশ থেকে পড়ে যাবার কথা স্মরণ করেন। ওই শ্রমিক নাকি কাজের মাঝে ই- ঘোড়ার ঘুম ঘুমাচ্ছিল!
জ্যাক হামার কাটার মেশিন ড্রিল মেশিনের মতো মারাত্নক সব মেশিন নিয়ে কাজ করে থাকে এরা। এমডি যেন একটু আঁতকেই ওঠেন।
নিজ দেশের শ্রমিক সমস্যা পরদেশি শ্রমিক সমস্যা, যেনবা এক বিশ্বশ্রমিক সমস্যা নিয়ে হাবুডুবু খেতে থাকলেন তিনি।
আহ। মানুষের কতরকমের কষ্ট কতরকমের সমস্যাযে থাকে/ আছে এ জগতে?
তিন জন একদফা এক দাবি পেশ করলযে, যারা ভয়ংকর শব্দ করে ঘুমচ্ছে, তাদের কে চিহ্নিত করে, একঘরে রাত্রি যাপন করতে দেয়া হোক।
এমডি ২৪ ঘণ্টা সময় নিলেন।
৪৮ ঘণ্টা পর। ওই তিন অভিযোগকারির রুমের দুজন নাকডাকা শ্রমিককে, আদেশ দেয়া হল, ও রুমের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে, কেবল তখনই তারা ঘুমুতে যাবে।
দুজন লেবারের দূর্ভোগ বেড়ে গেল। ওরা মানিকজোড় হয়ে রাত বারটা পর্যন্ত বাইরে বসে থাকে- দুঃখি দুঃখি মুখ করে। অপরাধ না করেও অপরাধী তারা। এ অমানবিক দণ্ডদানে তারা বেজায় নাখোশ ও মর্মাহত।
সেরাতে একজন বাইরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করে, ভেতরের সবাই ঘুমিয়েছে কী না?
সে ঘরে ঢুঁকে শুতে যাচ্ছিল, পাশের একজন উচ্চস্বরে ‘ বাই’ সেরে বলল, ওই শালা বেরো ঘর থেকে, দেখতে পাস না, আমি ঘুমোই নি!
আরেকদিন। এমডি সাহেব , ফোরম্যান ও লেবারদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন। শেষপর্যন্ত তিনি নাকডাকার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিলেন কিন্তু সমাধান দিতে পারলেন না।
এক বাঙালি লেবার প্রস্তাব দিলঃ যারা নাক ডেকে ঘুমায়, তারা আজ থেকে ডান বা বাম কাত হয়ে শুয়ে থাকবে– চিৎ হয়ে শোবে না। আর শোয়ার আগে নাকে সর্ষে তেল দিয়ে ঘুমুতে যাবে।
হ্যা এটা বৈজ্ঞানিক সমাধান হতেও পারে, বললেন এমডি।
জেদ্দা শহরের ‘ দানা’ মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে এলো আর ওরা চটজলদি ওঠে পড়ল।
[ গল্পটি আমার বাল্য( পাশের গ্রামের) বন্ধু হারুন ার রশিদ সাত্তাররুল লিখতে বলেছিলেন। তিনি একসময় নাটক লিখতেন। তিনি এখন জেদ্দায় কর্মরত]