ঢাকা | ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪ - ১১:৩১ অপরাহ্ন

তানোর কৃষি অফিস আকুন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত 

  • দৈনিক নবোদয় ডট কম
  • আপডেট: Saturday, September 28, 2024 - 5:15 pm
  • News Editor
  • পঠিত হয়েছে: 46 বার

সোহানুল হক পারভেজ রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান:
রাজশাহীর তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহমেদের বিরুদ্ধে সরকারি বরাদ্দের প্রতিটি খাতেই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে কৃষি অফিসটাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করছেন।

কৃষকদের জন্য ধান,সয়াবিন, বাদাম ও ভুট্টা কাটার যন্ত্রপাতি বরাদ্দ এনে তা প্রকৃত কৃষকদের না দিয়ে তার পছন্দের লোক দিয়ে অন্যদের নিকট বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ট্রেনিং, প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর নামে কৃষকদের এনে নামমাত্র নাস্তা ও সামান্য নগদ টাকা ধরিয়ে দিয়ে সাদা কাগজ স্বাক্ষর ও টিপসই নিয়ে বিদায় করা হয়। কৃষি অফিসটা দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত করছেন এই দুর্নীতিবাজ  কর্মকর্তা।

অভিযোগ উঠেছে, কৃষক প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস, প্রদর্শনী, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি ও দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বরাদ্দসহ বিভিন্ন খাতের বরাদ্দের সিংহভাগ লুটপাট হচ্ছে। তাঁরা কৃষকদের নিয়ে একটি ফসলের মাঠ দিবসের অনুষ্ঠান করে ব্যানার টাঙিয়ে ছবি তুলে রেখেই বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করে চলেছেন। এ ছাড়া প্রতিটি বরাদ্দের কলাম ফাঁকা রেখেই স্টক-রেজিস্টারে নেওয়া হয় কৃষকদের স্বাক্ষর ও টিপসই।

এসব অভিযোগের সত্যতার খোঁজে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রদর্শনীতে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষকদের জন্য বরাদ্দের চার ভাগের তিন ভাগই চলে যাচ্ছে কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহমেদের পকেটে। সরকারি বরাদ্দের এক-চতুর্থাংশও কৃষকরা পাচ্ছেন না। অফিসের যন্ত্রপাতি (মেশিন) থেকে শুরু করে প্রতিটি খাত থেকে কৃষি কর্মকর্তার বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশ গ্রহণকারী কৃষকদের মানসম্মত নাস্তা ও খাওয়ার দেওয়া হচ্ছেনা বলেও জানান অন্তত কুড়ি জন কৃষক।

বেশির ভাগ কৃষকই জানেন না, তাঁদের জন্য সরকার কি পরিমাণ বরাদ্দ দিচ্ছে এবং কৃষকরা পাচ্ছেন কতটুকু। তাঁরা বলছেন, আমরা তো এত কিছু জানিও না, আর বুঝিও না। কৃষি অফিসে বরাদ্দের পরিমাণ জানতে চাইলে পরে আর কিছুই দেয় না। উল্টো তার নাম কেটে দেওয়ার হুমকি ধমকিও দেন এ কর্মকর্তা। এতে কৃষকরা মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। কৃষি অফিস বলছে, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরিষা, খেসারি, মসুর, চিনাবাদামসহ বিভিন্ন ফসলের প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে, এবং কৃষকদের সব বরাদ্দ পূর্ণভাবে বণ্টন করা হয়েছে।

কিন্তু নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একটি সূত্র বলছে, উন্নত মানের ধান, গম, পাট ও ভুট্টার বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণের নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫ জন কৃষককে ৫ একরের একটি করে প্রদর্শনী প্লট দেওয়ার কথা। কোন গ্রুপে ১৫ হাজার আবার কোন গ্রুপে ১০ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় না। হেক্টর-প্রতি কৃষকের জন্য যে পরিমাণ বীজ, সার, কীটনাশক,নগদ টাকাসহ যেসব উপকরণ দেওয়ার কথা, তাও দেওয়া হয়েছে নামমাত্র। সরেজমিন তদন্ত করলে সত্যতা পাওয়া যাবে।

এএসসিপি প্রকল্পের মাধ্যমে রয়েছে কৃষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। প্রতিটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন ৩০ জন কৃষক। ওই প্রশিক্ষণে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী কৃষকের জন্য খাবার বাবদ বরাদ্দ ৪০০ টাকা এবং ব্যাগ বাবদ ৬৫০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কৃষকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ১০০ টাকা দামের ১ প্যাকেট বিরিয়ানি আর ১০০ থেকে ১৫০ টাকার একটি ব্যাগ। তাদের অভিযোগ বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশ গ্রহণকারী কৃষকদের মানসম্মত নাস্তা ও খাওয়ার দেওয়া হচ্ছেনা।

এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার নিকট কৃষক ও যন্ত্রপাতি বরাদ্দের তালিকা চাইলে তিনি আজ নয় কাল,এমন তালবাহানা করে তালিকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ প্রতিবেদক কাগজপত্রের জন্য কৃষি অফিস অন্তত তিনবার গিয়ে তার কাছ থেকে এসব তথ্য নিতে পারেননি।

একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে,চলতি বছরে  উপজেলায় ভুট্টা কাটার মেশিন,কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন, টি,রিপার,রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ওয়াকিং টাইপ ও পাওয়ার স্প্রয়ার  বরাদ্দ দেওয়া হয়। উপজেলায় ভুট্টা চাষ না হলেও এ কর্মকর্তা লুটপাটের উদ্দেশ্যে ধান কাটার মেশিন বাদ দিয়ে ভুট্টা কাটার মেশিনের চাহিদা প্রেরণ করেন। এতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে মেইজ শেলার (ভুট্টা মাড়ার মেশিন) বরাদ্দ দেন।

মেশিনগুলো প্রকৃত কৃষকদের না দিয়ে তার অনুগত লোকজনের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে ফটোসেশান করে ওই মেশিন অন্যদের নিকট নামেমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেন। রিপার পেলেও ওইগুলো তার পছন্দের এক কীটনাশক ব্যবসায়ী দালালের মাধ্যমে  বিক্রি করার অভিযোগ উঠে। কামারগাঁ ইউপির এক গ্রাম পুলিশের কাছে টাকা জমা নিয়ে তার নামে মেশিন বরাদ্দ এনে অন্যর কাছে বিক্রি করেছে।

এছাড়াও পুষ্টি বাগানের জন্য বিভিন্ন গ্রুপে এক জন কৃষককে ৩ হাজার ৭০০ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতি কৃষককে ৫টি গাছের চারা,২৫০ টাকার বীজ, ও ৪৫০ টাকার সার দিয়ে বাকি টাকা সম্পূর্ণ তার পকেটে ঠুকান বলে অভিযোগ করেন  কৃষকেরা।
এসএসিপি প্রকল্পের আওতায় বাগান পরিচর্যার জন্য শতাধিক কৃষককে ট্রেনিং দেওয়া হয়।

এতে প্রত্যেক কৃষকের জন্য ১০ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়ার কথা থাকলেও কৃষি কর্মকর্তা সাদা-কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দুইভাগ ৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। এ নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কর্মকর্তার বাকবিতণ্ডা ও মৃদু হাতাহাতি হয়েছেন বলে কৃষকেরা  জানান।
এছাড়াও এসএসিপি প্রকল্পের আওতায় কৃষক ট্রেনিংয়ের নামে ২০ টাকার নাস্তা,১২০ টাকার দুপুরের খাওয়া ও নগদে ২৫০ টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ভাবেই চলছে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরটি।

এসএসিপি প্রকল্পে ট্রেনিং নেওয়া এক কৃষক বলেন, একবার একটা ট্রেনিং করে তিনি ৮০০ টাকার ভাতা পেয়েছেন। অপর এক কৃষক  জানান, তার একটি পুষ্টি বাগান রয়েছে। কখনো ট্রেনিং করেননি। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে একটা আমের চারা, লেবুর চারা ও একটি সাইনবোর্ড ছাড়া তিনি কিছুই পাননি।

আড়াদীঘি ও মাদারীপুর এলাকার দুই কীটনাশক ব্যবসায়ী বলেন, এবার লাইসেন্স নবায়নে কৃষি কর্মকর্তা ৫ হাজার টাকা করে আদায় করেছেন।
বরাদ্দের বিষয়ে অফিসের এক সহকারী বলেন, কৃষক ও কৃষি যন্ত্রপাতি বরাদ্দের কোনো কপি আমাদের দেওয়া হয় না। অফিস থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয়, আমরা ডায়েরিতে নোট করে নিই।

এ বিষয়ে  উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহমেদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। তবে তার আমলে কৃষকদের বরাদ্দ সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে বলেন, আপনাদের পছন্দের কেউ থাকলে নাম দিতে পারেন। আমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপনাদের দেওয়া নামগুলোকে বরাদ্দের আওতায় নিয়ে আসবো।