মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই রুখতে পারে মৌলবাদ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়-সা ম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা থেকেই জঙ্গিবাদের সৃষ্টি। আমাদের দেশে বিভিন্ন নামে জঙ্গিবাদের আলামত স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আলকায়দা এবং আইএস নামে যে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো আছে, তারা সরাসরি বাংলাদেশে অবস্থান এবং নেটওয়ার্ক বিস্তার করছে কি না, তা বলা যাবে না। আইএসের লক্ষ্য হলো একটি ইসলামি খেলাফত কায়েম করা। তারা মনে করে, একসময় ইসলামের পতাকা সারা দুনিয়ায় উড়বে।
এ লক্ষ্যে তারা সম্প্রসারণবাদী, আগ্রাসি মতাদর্শ নিয়ে এগোচ্ছে। একই মতাদর্শে বিশ্বাসী যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, পরে তারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসা লোকগুলো এখনো পুরোনো ধ্যান-ধারণা লালন করছে। অর্থাত্ তারা ধর্মীয় চিন্তাচেতনার একটি জাতি এবং রাষ্ট্র গঠনে বিশ্বাসী। তারাই স্বাধীনতাবিরোধী এবং পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। বর্তমানে জামায়াতে ইসলাম নামে যে রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে, ’৭২-এর সংবিধানে আইন করে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এসে বিভিন্ন দলকে রাজনীতি করার নামে আসলে জামায়াতকেই ফের প্রতিষ্ঠিত করে। জামায়াতের আমির নাগরিকত্বহীন গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
এমন একটি অবস্থা নিশ্চিত করা হয়, যা কোনোভাবেই আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আজকে বাংলাদেশে হিজবুত তাহরির থেকে শুরু করে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ, হরকাতুল জিহাদ এবং আনসারউল্লাহ বাংলা টিমসহ বিভিন্ন নামে উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে আলকায়দা বা আইএসের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও আদর্শগতভাবে তারা একই এবং পরষ্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করার একটি প্রক্রিয়া তাদের আছে। সব দেশে আইএস নামে তারা কার্যক্রম চালাবে এমনটি নয়। তারা সহযোগী সংগঠন এবং ভাড়াটিয়া সংগঠন দিয়ে অপকর্মগুলো চালাতে পারে। সে দিক থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনবল, প্রযুক্তি, পরিবহন ও বেতনভাতাসহ নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জেএমবিসহ নানা জঙ্গি সংগঠন দমন করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে—এ কথা স্বীকার করতেই হবে।
তার পরও কেবল পুলিশি শক্তি, গোয়েন্দা অর্থাত্ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না, এক্ষেত্রে মানবিক সম্পদ উন্নয়নে নজর দিতে হবে। সামাজিক কর্মসূচি যেমন, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক। মানুষ কেন জঙ্গি হচ্ছে? এর মূল কারণ কিন্তু সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনা। যারা আজ জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে, তারা দরিদ্রের দরিদ্র। তারা অধ্যয়ন করতে গিয়ে আধুনিক শিক্ষা কারিকুলামের বাইরে বিপরীত কিছু শিখছে। এসব শিক্ষা কার্যক্রম তাদের ধর্মীয়ভাবে একপেশে হতে শেখাচ্ছে। নিজের মতাদর্শ শ্রেষ্ঠ অন্যেরটা নয়—এমন শিক্ষায় তারা অন্য ধর্মবিদ্বেষী হয়ে উঠছে। তাদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস এমনভাবে জাগ্রত করানো হয়েছে, যাতে তারা জিহাদের নামে মতাদর্শ জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য হত্যা থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে জড়িত। এ কাজ করতে গিয়ে কেউ যদি আহত-নিহত হয়, তাতেও কিছু আসে যায় না। এই জঙ্গিবাদ উত্থানের বড় কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা। সমাজে অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে একটি বঞ্চিত ও অবহেলিত শ্রেণি রয়েছে। এই বঞ্চিত শ্রেণিকে খুব সহজে ভয় এবং প্রলোভন দেখিয়ে বশ করা যায়। কারণ তাদেরকে বেহেস্তের লোভ দেখানো হয়। যারা নানা অভাব-অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করে তারা বেহেশতের আরাম-আয়াশের লোভে সহজে এসব কাজে উদ্বুদ্ধ হয়। যে ব্যক্তি সুইসাইড করতে উদ্বুদ্ধ হয় তাকে ফেরানো দুনিয়ার কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়।
আমরা ’৯০-এর পর থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা আবার শুরু করেছি। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলই হলো প্রধান স্টেকহোল্ডার। কিন্তু সেই রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা কী, তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিং নিয়মিত হয় কি না, হলেও কী সিদ্ধান্ত হয় ইত্যাদি বিষয়ের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হতে পারত। ২০১৫ সালের শুরুতে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি অবরোধ দেওয়া হয়েছিল, তা এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। কেবল তাই নয় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় হওয়ার পরও আমৃত্যু এই ব্যক্তি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিল। মরণোত্তর সদস্য পদ বহাল আছে কিনা তা এখনও জানা যায়নি। বিএনপির বিবৃতিতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাকা চৌধুরী ভূমিকা স্মরণীয় ছিল বললেও তার ফাঁসির মধ্য দিয়ে স্থায়ী কমিটির পদটি শূন্য হয়েছে এমন কথা বলেনি। যুদ্ধাপরাধীদের দলের সঙ্গে থাকলে কী হয় বিএনপি তা জেনেও বের হয়ে আসতে পারেনি। এটি গেল বিএনপির অবস্থা।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যেভাবে সংগঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। সহযোগী অনেক সংগঠনের কমিটি নেই। তৃণমূলের অবস্থাও খারাপ। পৌর নির্বাচন পরিচালনা কমিটি কীভাবে হবে তাও নির্ধারণ করা হয়নি। অথচ যদি প্রতিটি জেলায় কমিটি শক্তিশালী থাকত তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হত। অনেক জায়গায় জেলা কমিটি নেই, থাকলেও ১০/১২ বছরের পুরোনো। কাজেই নানা সমস্যা ক্ষমতাসীন দলেও আছে। এই সমস্যা রাতারাতি সমাধান হবে না। আওয়ামী লীগও সহযোগী সংগঠনগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে যেসব সহযোগী সংগঠন রয়েছে, এর বাইরে নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী, ওলামা লীগ, প্রজন্ম লীগসহ নানা নামে সংগঠন রয়েছে।
এসব সংগঠনের কোনো কোনোটি নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে এবং গণমাধ্যমেই কাভারেজ পাচ্ছে। যেমন ওলামা লীগ নামে কোনো সংগঠন আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নেই। এই ওলামা লীগ আবার দুই তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ বলছে, অন্যরা জঙ্গি সংগঠন এবং বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত। জনবিচ্ছিন্ন কতকগুলো ফটকাবাজ লোক এরকম প্রায় ৫০টি সংগঠনের নামে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ব্যানার, ফেস্টুন টাঙায় এবং মাইক ভাড়া করে বক্তৃতা দেয়। সেখানে আওয়ামী লীগের লোকজনকেও দেখা যায়। কাজেই এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া উচিত, এসব সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এদের কোনো কর্মকাণ্ডের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না।
আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছি, কিন্তু সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ছি। রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের চর্চা নিয়ে কাজ করতে হবে। নির্বাচনের ছয় মাস আগে থেকে আমরা চিন্তা করি, নির্বাচন কীভাবে হবে, নিরপেক্ষতাসহ নানা বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করি। কিন্তু আমাদের মূল যে সমস্যা, স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের পক্ষেই মৌলবাদবিরোধী সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ।