কুলাউড়ায় মনু নদীতে মাছ হাট উৎসব সম্পন্ন
সেলিম আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট: মৌলভীবাজার জেলার সর্ববৃহৎ মনু নদীতে উৎসবের আমেজে শত বৎসরের ঐতিহ্যবাহী তিন দিনব্যাপী আয়োজিত ‘মাছ হাট উৎসব’ ১৪ ডিসেম্বর সোমবার বিকেলে শেষ হয়েছে। টানা তিন দিনব্যাপী এ উৎসবে জেলেদের পাশাপাশি সহস্রাধিক বিভিন্ন পেশার সৌখিন মৎস্য শিকারীরা অংশ নেন। স্থানীয়ভাবে ওই উৎসবের নাম ‘মাছ হাট’।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শুষ্ক মৌসুমে ৩ দিন ব্যাপি নদী পারের আশে পাশের জনগোষ্ঠির অংশ গ্রহনে ১৪ ডিসেম্বর শেষ দিনে বিরল প্রজাতির প্রায় ৫ কেজি ওজনের একটি বাঘ মাছ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকারীদের জালে ধরা পড়ে। এ সময় হাট উৎসবে কেন্দ্র করে কুলাউড়া উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের মনু রেল সেতু থেকে সীমান্তবর্তী বেলেরতল পর্যন্ত সহ¯্রাধিক মাছ শিকারী অংশ গ্রহণ ও উৎসুক জনতার পদচারনায় মিলনমেলায় পরিনত হয়। এক সাথে হাজারো মানুষের মাছ ধরার উৎসব দেখতে নদীর দুই পাশে হাজার হাজার উৎসুক মানুষকে ভীড় করতে দেখা যায়।
সোমবার দুপুরে বেলেরতল এলাকা থেকে স্থানীয় কঠারকোনার জেলে আব্দুল আলীর জালে ধরা পড়ে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির বাঘ মাছ। ৫ কেজি ওজনের মাছটি ক্রয় করতে উৎসুক মানুষ ভীড় করলেও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের বাসিন্দা সমকালের কুলাউড়া প্রতিনিধি সৈয়দ আশফাক তানভীর ৫ হাজার টাকা দিয়ে মাছটি ক্রয় করেন।
জেলার কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর। এই তিন উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে চলা দীর্ঘ মনু নদীর কুলাউড়া উপজেলা অংশে চলছে এমন ব্যতিক্রমী ঐতিহ্যবাহী উৎসব। তিন দিন ব্যাপী ওই উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন স্থানীয় নানা শ্রেণী পেশার সৌখিন ও পেশাদার মানুষ। আর তা দেখতে ভীড় করছেন দূরদূরান্ত থেকে আগত কয়েক হাজার সৌখিন মানুষ। শনিবার সকাল সাড়ে নয়টায় মনু নদীর কুলাউড়া উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়ন অংশে মনু-কটারকোনা রেল ও সড়ক সেতুর পূর্ব স্থান থেকে এই উৎসবের যাত্রা শুরু হয়। ওই দিন সকালে স্থানীয় বাসিন্দারা মাছ ধরার নানা ফাঁদ নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে নামেন। প্রচন্ড শীতের মাঝেও উৎসবের আমেজ তখন নদীর দুই পাড়ে। সৌখিন ও পেশাদার শিকারীরা পলো, কুচা, ঝাকি জাল, প্লেন জাল, টানা জালসহ নানা জাতের ফাঁদ নিয়ে তারা নদীতে মাছ শিকারে নামেন। কেউ নৌকায়, কেউ বা কলাগাছের ভেলায় চেপে।
অনেকেই আবার নদীর চর জাগা অথবা শুকনো স্থান থেকে ঝাকি জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্ঠা করেন। কেউ কেউ নদীতে নেমেও মাছ ধরেন। ‘মাছ হাট’ উৎসবটি নদীর বিভিন্ন বাঁকে যে স্থানে ডহর রয়েছে সেসব স্থানেই উৎসব চলে মাছ হাট। এ দৃশ্য দেখতে জেলার নানা স্থান থেকে লোকজন ভীড় করেন ওই স্থানগুলোতে। তারা মাছ ধরা দৃশ্য দেখার পাশাপাশি মাছও ক্রয় করেন। মনু নদীর মাছ সুস্বাদু ও সতেজ থাকায় তা কিনতে মানুষের আকর্ষণও বেশি। তবে শুধু কেনা বেচাই নয়। প্রতিবছরই পালিত হয়ে আসা এই উৎসবটি স্থানীয় ঐতিহ্যেরই অংশ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ওই এলাকার বিবাহিত মেয়েরা বাবার বাড়ি নাইওর (বেড়াতে) আসেন। অনেকেই আবার নতুন জামাইকে দিয়ে মাছ ধরাতে এই উৎসবে নিয়ে আসেন।
তাই উৎসবটি স্থানীয়দের কাছে ব্যতিক্রমী উৎসব। প্রথম দিনই সাইফ আহমদ, ছয়ফুল ইসলাম, কালাম মিয়া, তায়েফ আলী, রহমান মিয়া, কামরুল ইসলামসহ অনেকেই বড় বোয়াল, আইড় ও কাতলা মাছ ধরেন। তারা জানান, অন্যান্যদের জালে ও ফাঁদে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আইড়, ঘাঘট, বোয়াল, রুই, কাতলা, বাছা, বাঁশপাতা, ছেলাপাতা, টেংরাসহ নানা জাতের দেশীয় প্রজাতির মাছ। তারা মাছ পাওয়ায় বেজায় খুশি। দ্বিতীয় দিন সুজাপুর ছৈদল বাজার ডহরে মাছ ধরা হয়। তৃতীয় দিন হাজীপুর, শরীফপুর, পৃথিমপাশা এলাকায় ধলিয়া বেলেরতল ডহরে মাছ ধরার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তিন দিনের এ ‘মাছ হাট’ উৎসব।
হাজীপুর এলাকার বাসিন্দা সাংবাদিক সাইফুল আলম জানান, প্রাচীন যুগ থেকে এই নদী থেকে এভাবে উৎসবের মধ্যে দিয়ে মাছ ধরা হয়। এটি এতদ অঞ্চলের ঐতিহ্য হিসেবে খ্যাত। বিশেষ করে ২০ ভাগ জেলে ও ৮০ ভাগ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সৌখিন মানুষ এই উৎসবে মাছ শিকার করতে আসেন।
লংলা আধুনিক ডিগ্রি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম বলেন, নদী পাড়ের জনগোষ্ঠি নদীকে ভালবাসেন বলেই শত বছর থেকেই প্রজনন মৌসুম শেষে শুষ্ক মৌসুমে এ শিকারে মেতে ওঠা একটি ঐতিহ্যের নিদর্শন। তবে নদী দূষণ ও নদী থেকে যত্রতত্র অবাধে বালু উত্তোলন, নদী খননের অভাবে পরিবেশগত কারনে মাছ উৎপাদন এবং প্রজনন কমে গেছে।