ঈশানবাংলার পৌষ পার্বন
বিপ্লব গোস্বামী : সংক্রান্তি বলতে আমরা বুঝি মাসের শেষ দিন। কিন্তু জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে সূর্যাদি এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন করার নাম হচ্ছে সংক্রান্তি।এক বছরের বারো মাসে সূর্য বারো বার বারো রাশিতে গমন করে। পৌষ সংক্রান্তিতে সূর্য মকড় রাশিতে গমন করে। তাই এই সংক্রান্তি মকড় সংক্রান্তি নামে পরিচিত। এই মকড় সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তি হিন্দু ধর্মের এক বিশেষ উৎসব। বিশেষ করে বাঙ্গালীদের কাছে পৌষ সংক্রান্তি এক বিশেষ উৎসব।এই দিন হিন্দু বাঙ্গালিরা বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। অঞ্চল ভেদে এই উৎসব ভিন্ন ভাবে ও ভিন্ন নামে পালিত হয়ে থাকে। অঞ্চলে ভেদে এই উৎসবের নামে ,বৈশিষ্ট্য ও মেয়াদ আলাদা হয়ে থাকে। কোথাও দু’দিন আবার কোথাও কোথাও চার দিন পর্যন্ত উৎসব চলে। উত্তর পূর্ব ভারতের ঈশান বাংলা অর্থাৎ বরাক উপত্যকা ও ত্রিপুরায় এই উৎসব তিল সংক্রান্তি বা সংক্রান্তি নামে পালিত হয়। বাংলাদেশে এই উৎসবের নাম পৌষ সংক্রান্তি। আসামের বহ্মপুত্র উপত্যকায় ভোগালি বিহু নামে পালিত হয়।এছাড়া তামিলনাডুতে পোঙ্গল,কর্ণাটকে ইল্লুবিল্লা ও মকড় সংক্রমনা ,মহারাষ্ট্রে তিলগুল,গুজরাটে উত্তরায়ণ ও নেপালে মাঘী উৎসব নামে পালিত হয়।
ভিন্ন স্থানে এই উৎসব ভিন্ন ভাবে পালিত হলেও ঈশান বাংলা অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব ভারতে এই উৎসব সংক্রান্তি বা তিল সংক্রান্তি নামে পালিত হয়।জ্যোতিষ মতে পৌষ সংক্রান্তির শেষ দিনে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে গমন করে।শাস্ত্রমতে দক্ষিণায়ণে দেবতারা নিদ্রিত থাকেন আর উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্ৰত থাকেন।ধর্ম মতে দক্ষিণায়ণে মৃত্যু হলে পুনর্জন্ম হয় আর উত্তরায়ণে মৃত্যু হলে মোক্ষ লাভ হয় । তাই পিতামহ ভীষ্ম এই দিন শরসয্যায় ইচ্ছা মৃত্যু গ্ৰহণ করে স্বর্গে গমন করেছিলেন।অন্য এক মতে এই দিন অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। ভগবান বিষ্ণু অসুরদের বধ করে তাদের মুণ্ড মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলেন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এই দিন অশুভ শক্তি বিনাশ হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরাণ মতে এই দিন সূর্যদেব মকড় রাশির অধিপতি নিজ পুত্র শনিদেবের বাড়িতে এক মাসের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলেন। এই অনুযায়ী এই দিন পিতা পুত্রে মিলনের এক বিশেষ মুহুর্ত বলে মানা হয়। সেই মতানুসারে ঈশান বাংলার বাঙ্গালিরা এই দিন তিল,চাউল,দুধ, গুড়,তিলুয়া , নতুন চালের পিঠা ও মিষ্টি দিয়ে অর্ঘ্য প্রদান করেন।
পৌষ সংক্রান্তি বাঙ্গালি সংস্কৃতির এক বিশেষ দিন।যদিও এই উৎসব এক এক অঞ্চলে এক এক ভাবে পালিত হয়। ঈশানবাংলায় এই উৎসব এক বিশেষ ভাবে পালিত হয়ে থাকে।বিশেষ করে ঈশানবাংলার গ্ৰামাঞ্চলের মহিলারা এই উৎসব অন্য এক বিশেষ ভাবে আযোজন করে থাকেন । সংক্রান্তির প্রায় সপ্তাহ দিন আগে থেকেই আরম্ভ হয় উৎসবের আযোজনের।বাড়ির উঠান প্রথমে উজ্জ্বল মাটির হালকা আস্তরন দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। তারপর চাউলের গুড়ি দিয়ে অঙ্কন করা হয় আলপনা। কোন কোন মহিলা রঙিন আবির দিয়ে অঙ্কন করে বিশেষ আলপনা। শুধু আলপনা নয় সেই সঙ্গে অঙ্কন করেন ধনের দেবী লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ ও ধান গাছ ও ধানের শীষর ছবি। কোথাও কোথাও অঙ্কন করা হয় গরু, লাঙ্গল ও গরুর পায়ের ছাপ।
আজও ঈশানবাংলার গ্ৰামাঞ্চলে সংক্রান্তির দিন বের হয় নগর কীর্তন। এদিন গ্ৰাম বরাকের প্রায় প্রতি গ্ৰামেই সকাল হতে বিকেল পর্যন্ত চলে নগর পরিক্রমা। খোল, কলতাল, কাশি, বাঁশি ও হাত তালি দিয়ে শ্রীনামের মাধ্যমে করা হয় এই নগর কীর্তন।এই নগর কীর্তন কোথাও বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবার কোথাও কোথাও শুধু পথে পথে। যেসব গ্ৰামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নগর কীর্তন হয় সেসব গ্ৰামে বাড়ীতে কীর্তন আসলে বাড়ির মেয়েরা ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে ও উলুধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানান। প্রতি বাড়িতেই নকুলদানা, তিলুয়া, বাতাস, কমলা, না
সংক্রান্তির দু এক দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় পিঠা-পুলি তৈরির কাজ। বিশেষ করে সংক্রান্তির আগের দিন রাতে ঈশানবাংলার গিন্নীরা নতুন ধানের গুড়ি দিয়ে রাত ভর তৈরি করেন বিভিন্ন ধরণের পিঠা। বিশেষ জনপ্রিয় পিঠার মধ্যে মালপোয়া, পাটিসাপটা, বকফুল, আলুপি
ঈশানবাংলার গ্ৰামাঞ্চলের খুব জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে চুঙ্গাপিঠা। সংক্রান্তির বাজারে ঢলু বাঁশের চুঙ্গার চাহিদা খুব বেশি।চড়া দাম হলেও দু চারটি ঢলু বাঁশের চুঙ্গা কিনতেই হয় প্রতি পরিবারে। বাঁশের ভিতর বিন্নি ধানের চাল ঢুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হয় চুঙ্গাপিঠা। তারপর সেই পিঠায় দুধ,চিনি,নারিকেল ও দই মিশিয়ে সপরিবার মিলে খাওয়া হয় সেই চুঙ্গাপিঠা। পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণও করা হয় ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গাপিঠা।
ঈশানবাংলার পৌষ পার্বনের এক বিশেষ অঙ্গ হচ্ছে মেড়ামেরি। গ্ৰাম বরাকের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সংক্রান্তির দশ পনেরো দিন আগে থেকেই আমন ধানে ন্যাড়া (ধান কেটে নেওয়ার পর যে অবশিষ্ট অংশ থাকে) কেটে এনে মজুত করে রাখে। তারপর কাঁচা বাঁশ কেটে এনে সংক্রান্তির ঠিক এক দিন আগে থেকে শুরু করে মেড়ামেরি তৈরির কাজ। সংক্রান্তির দিন সম্পূর্ণ হয় মেড়ামেরি ঘর তৈরি। সংক্রান্তির দিন রাতে সেই মেড়ামেরি ঘরে রান্না করে খাওয়া দাওয়া হয়। অনেকে মাইক বাজিয়ে মজা করে রাত কাটায় সেই ঘরে। পরের দিন কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে মেড়ামেরিতে আগুন দেওয়া হয়।শীতে কাঁপতে কাঁপতে মেড়ামেরির আগুনে সবাই মিলে তাপ নেয়। মেড়ামেরির আগুনে কাঁচা বাঁশের আখি পুড়ে গুলির মত শব্দ করে ফোটে তখন সবাই মিলে খুব আনন্দ করে। এই মেড়ামেরি ঈশানবাংলার সংস্কৃতির এক খুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ঈশানবাংলায় সংক্রান্তির দিন বিকালবেলা কোথাও কোথাও রথ টানারও প্রচলন আছে। সেই রথ উপলক্ষ্যে আয়োজন হয় বিশেষ মেলার। মানুষ ঢল নামে সেই সব মেলায়। মেলায় বসে বিভিন্ন ধরণের দোকান। বিকি-কিনি হয় রকমারি জনিসের। এই দু’দিনের আনন্দে কিছুতেই মন ভরেনা কারো। সবাই চায় এই উৎসব যেন আরোও কয়েকটা দিন ধরে চলুক।