বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন ইয়ার- ২০২১ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হোক
তানিজা খানম জেরিন : বিশ্ববাসীর বড় আশা ছিল ২০২১ সনের প্রথমেই করোনার ভ্যাকসিন পাবার কিন্তু একদল গবেষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে নয় মাসের মধ্যেই আমরা যুগান্তকারী ভ্যাকসিন পেয়ে গেলাম। করোনা ভ্যাকসিনের চূড়ান্তভাবে বিভিন্ন ধাপ এবং পর্যায় অতিক্রম করে ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ আমেরিকার নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ড জুইস মেডিকেল সেন্টারের স্বাস্হ্যকর্মী সান্ড্রা লিন্ডসেকে প্রথম ভ্যাকসিন দিয়ে ভ্যাকসিনের কার্যক্রম শুরু হয়। গত তিন সপ্তাহে বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে এবং গত তিন সপ্তাহে আমেরিকায় আধাকোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের সর্বত্রই রাজনৈতিক মারপ্যাচ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা ভ্যাকসিন গ্রহণে অনীহা এবং সুষ্ঠু বিতরণ ও সঠিক প্রয়োগের পরিকল্পনার অভাবে একটি হ য ব র ল অবস্হার সৃষ্ঠি হয়েছে বা ধীর গতিতে চলছে। যদিও স্বাস্হ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা স্বাভাবিকভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে এবং বিশ্বের সবাই ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে এক থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে। তবে তারা আশাবাদী এবং বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হার মতে আরো কয়েকটি দেশে দ্রুত ভ্যাকসিন আবিস্কার হলে হয়তো আগামী দুই বছরের মধ্যেই সমস্ত বিশ্ববাসীকে ভ্যাকসিন প্রদান করতে সক্ষম হবে। আমেরিকানবাসী আশাবাদী নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর এক’শো দিনের বিশেষ কর্মসূচীতে এক’শো মিলিয়ন মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে এবং এ কার্যক্রম যদি অব্যাহত থাকে তবে দুই হাজার একুশ সনের মধ্যেই সকল জনগণকে ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব হবে।
করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পূর্ব থেকেই এবং বর্তমানে ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কুচক্রীমহল ভ্যাকসিন গ্রহণের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে গুজব ছড়াচ্ছে এবং মৌলবাদীরাও ফতোয়া দেওয়া শুরু করেছে কোন দেশের কোন ভ্যাকসিন হালাল বা হারাম; এমনকি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট- জয়ের বলসোনারো তার দেশের জনগণকে অদ্ভুতসব কথা বলেছেন:- ফাইজারের তৈরি করোনা ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ‘মেয়েদের গোঁফ গজানো, পুরুষের কণ্ঠ মেয়েলি হয়ে যাওয়া কিংবা মানুষ থেকে কুমিরে রূপান্তরিত হওয়া’র ভয় দেখিয়েছেন; কি আজব ভাবতেও অবাক লাগে বর্তমান এই ডিজিটাল বিজ্ঞানের যুগেও পাথর যুগের চিন্তাভাবনা। স্মর্তব্য আমরা যখন আমাদের ছেলে-মেয়েদের কে হাসপাতালে পর্যায়ক্রমে দশ/বারোটি ভ্যাকসিন/টিকা দেওয়া হয় তখন আমরা কিন্তু কোনদিনও ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করিনা এই টিকা কি হালাল না হারাম। উল্লেখ্য ইমুনাইজেশন কার্ড না থাকলে এই দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়না। স্বাস্হ্য সুরক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন ভ্যাকসিন/টিকা নেয়া বিশ্বের প্রতিটি দেশেই প্রচলিত ও বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হার নির্দেশে বাধ্যতামূলক।
আমাদের দেশে সত্তর এবং আশির দশকে ভ্যাকসিন নেয়ার ভয়ে স্কুল পালায়নি এমন দুঃসাহসীর সংখ্যা খুবই কম এবং ভ্যাকসিন নিয়ে সপ্তাহ খানেক জ্বরে ভুগেনি এবং ভয় পায়নি এমন ঘটনা বিরল। আরো উল্লেখ্য ভ্যাকসিন দেওয়ার পদ্ধতি ছিল খুবই ভয়ঙ্কর অনেক ভ্যাকসিন চক্রাকারে মাংস কেটে নেয়া হতো বা আড়াই ইঞ্চি সুঁই দিয়ে শত শত মানুষকে প্রয়োগ করা হতো। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞান পদ্ধতি অনেক উন্নত করেছে এক ড্রপ মুখে দিলেই জীবনে আর পোলিও হবার সম্ভবনা নেই বা রাত কানা রোগ হবেনা; এই ভ্যাকসিনের জন্যই কলেরা, যক্ষা, গুটি-বসন্ত স্প্যানি-ফ্লুর মত অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি বিশ্ব থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে। উল্লেখ্য অনেক ভ্যাকসিন জীবনব্যাপী স্বাস্হ্য-সুরক্ষা করে আবার ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় রোগের জন্য বছর বছরই ভ্যাকসিন নিতে হয়: তাই সবিনয়ে বলছি করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে কোন গুজবে কান দেবেন না এবং নিশ্চিত মনে ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন এবং অন্যকে ভ্যাকসিন গ্রহণে উৎসাহিত করুন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্য নিজ নিজ ডাক্তার বা হাসপাতালে সর্বদা যোগাযোগ করুন। মনে রাখবেন ভ্যাকসিন গ্রহণের দু’সপ্তাহ পর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তাই ভ্যাকসিন গ্রহণের পরবর্তী দু’সপ্তাহ এবং যতদিন করোনা সংক্রমণ বিদ্যমান অবশ্যই স্বাস্হ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করবেন। মুখোশ খোলা যাবেনা হাত ধোয়ার অভ্যাস পরিত্যাগের প্রশ্নই আসেনা।
বিবিসির খবরে জানতে পারলাম বাংলাদেশ সরকার গত রবিবার ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কেনার জন্য ছয়’শ কোটি টাকা জমা দেওয়ার কথা কিন্তু আরেক খবরে প্রকাশ সেরাম ইন্সটিটিউট তাদের তৈরি ভ্যাকসিন ভারতের বাইরে রপ্তানি করতে পারবেনা; আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাস্হ্য অধিদপ্তর ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন ব্যতিরেকেই বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালসের সঙ্গে চুক্তি করেছে এবং জনগণকে প্রতিটি ভ্যাকসিনের জন্য সোয়া পাঁচ ডলার ব্যয় করতে হবে উল্লেখ্য ভ্যাকসিনের মূল্য দুই ডলার সরকার ভ্যাকসিন কিনেছে চার ডলারে মধ্যস্থতাকারী পাবে সোয়া ডলার হায়রে বাংলাদেশ! ভ্যাকসিন ক্রয়ে এবং প্রাপ্তিতেই এই হ য ব র ল অবস্হা আর বিলি-বন্টন প্রয়োগ নিয়ে কি হবে কল্পনাও করতে চাইনা, পাঠক অপেক্ষা করুন আরো মুখরোচক অনেক খবরই পাবেন। স্মর্তব্য বাংলাদেশে গ্লোব বায়োটেক করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার যদি পৃষ্ঠপোষকতা করতো অথবা আরো কিছু ভ্যাকসিন গবেষক যারা ভ্যাকসিনের কাজে অভিজ্ঞ বাংলাদেশী দেশের বাইরে গবেষনায় কর্মরত সরকার যদি তাদেরকে দেশে এনে কাজে লাগাতো তাহলে দেশের জনগণ খুবই সস্তায় করোনার ভ্যাকসিন পেতো এবং বিশ্বে দেশের অনেক সুনাম অর্জিত হতো। এখনও সময় আছে করোনার ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারে পাইলটস স্কীমের আওতায় নিজস্ব পদক্ষেপ নিয়ে গ্লোব বায়োটেকের প্রকল্পটির দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
বিশ্বে বর্তমানে চরম প্রতিযোগিতামূলক প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে। ২০২১ সনকে বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হা কর্তৃক ভ্যাকসিন ইয়ার ঘোষনা করে বিশ্বে সকল জনগণের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা করতে হবে। প্রতিটা দেশেরই সরকারকে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি: রক্ষণাবেক্ষণ ও ভ্যাকসিন প্রয়োগের কার্যক্রম সঠিকভাবে নিশ্চিত করা অতি জরুরী। একটি সুখবর হলো আজই আমেরিকার নিউ ইয়র্কের সান্ড্রা লিন্ডসে দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সর্ব সাধারণকে ভ্যাকসিন গ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য নিজেরা প্রকাশ্যে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন এবং বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হা ইতিমধ্যে স্বল্পমূল্যে এবং বিনামূল্যে গরীব দেশগুলিতে ভ্যাকসিন প্রদানের প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। ২০২০ সন করোনা সংক্রমণের বছর হিসেবে শতাব্দীর বিভীষিকাময় বিপর্যয় হিসেবে স্হান করে নিয়েছে; আমরা চাই ২০২১ সন ভ্যাকসিন ইয়ার হিসেবে সারা বিশ্বের মানুষ করোনামুক্ত হোক; বিশ্বে সর্বক্ষেত্রেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হোক। ভবিষৎ প্রজন্ম মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য গবেষণা চালিয়ে ভাইরাস মুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাক। বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন ইয়ার- দুইহাজার একুশ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হোক।
তানিজা খানম জেরিন
কলামিস্ট নিউইয়র্ক