বংশ পরম্পরায় প্রতিভাধর সত্যজিৎ রায়
বিপ্লব গোস্বামী : বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।তিনি একাধারে ছিলেন চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক,সঙ্গীত পরিচালক ও সাহিত্যিক।গল্প থেকে চিত্রনাট্য সবইতে তাঁর দখল ছিল।বহু চলচ্চিত্রের প্রযোজনাও করেছেন তিনি।বহু চলচ্চিত্রে করেছেন সুরকারের কাজও।তাঁর এই প্রতিভা বংশ পরম্পরায় পাওয়া।তাঁর বংশানুক্রম প্রায় পাঁচ প্রজন্ম পর্যন্ত আলোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায় যে উনাদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।এ থেকেই প্রমাণিত হয় সত্যজিত রায় বংশ পরম্পরায় প্রতিভাবান ছিলেন।
সত্যজিৎ রায়ের পিতাকে চিনেন না এমন বাঙ্গালি পাওয়া অসম্ভব।তিনি ছিলেন বিখ্যাত বাংলা শিশু সাহিত্যিক ও ননসেন্স ছড়ার প্রবর্তক সুকুমার রায়।তিনি ছিলেন একাধারে কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক।তাঁর অমর সৃষ্টি আবোল তাবোল,হ-য-ব-র-ল, ও পাগলা দাশু আজও পাঠকের কাছে খুব জনপ্রিয়।
সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীরও ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার আধিকারী।তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রকর, প্রকাশক, জ্যোতির্
সত্যজিত রায়ের প্রপিতামহ কালিনাথ রায় ছিলেন সংস্কৃত,আরবি ও ফার্সিতে সুপণ্ডিত।তাছাড়া সত্যজিৎ রায়ের পূর্বজ রামসুন্দর দেব যশোদলের জমিদার রাজা গুণীচন্দ্রের জামাতা ছিলেন।তাঁদের আদি নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার চাকদহে । রামসুন্দর যশোদলের জমিদার রাজা গুণীচন্দ্রের মেয়েকে বিয়ে করার পর যশোদলে গুণীচন্দ্রের দানকৃত ভূমিতে বসবাস শুরু করেন।পরবর্তীকালে তাঁর বংশধররা সেখান থেকে সরে গিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার মসূয়া গ্ৰামে বসবাস শুরু করেন।সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের জন্ম এখানেই।উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন তাঁর মা বাবার আট সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্র সন্তান।ছেলে বেলায় তাঁর নাম ছিল শ্যাম সুন্দর।তাঁর চার বছর বয়সে তাঁর অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায় চৌধুরী তাকে দত্তক নেন এবং নতুন নাম দেন উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী।
কলকাতার সেই প্রতিভাবান বিখ্যাত সাহিত্য ও শিল্প সমাজের খ্যাত নামা রায় পরিবারে , ২রা মে ১৯২১ সালে জন্ম গ্ৰহণ করেন সত্যজিৎ রায়।সত্যজিতের বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয়।মা সুপ্রভা দেবী অনেক কষ্ট করে তাঁকে বড় করেন।তাঁর আট বছর বয়সে ১৯২৯ সালে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ হয়।তিনি প্রথমে বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট হাইস্কুলে তারপর কোলকাতার প্রেসিডেন্টি কলেজে পড়াশোনা করেন।সেখানে তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন।১৯৪০ সালে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মায়ের ইচ্ছায় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।সেখানে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু ও বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখে ছিলেন।
১৯৪৩ সালে মাত্র ৮০ টাকা বেতনে কলকাতার ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা “ডি.জে.কিমার” এ জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার হিসাবে কর্ম জীবন শুরু করেন সত্যজিৎ রায়।যদিও সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসাবে শুরু হয়, পরবর্তীকালে তিনি একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়ে উঠেন।প্রথমে কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ারে সাথে সাক্ষাত ও পরে লণ্ডনে সফর রত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি “দি লাদ্রি বিচিক্লেত্তে” দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মানে প্রদ্বুদ্ধ হন। ১৯৪৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “ক্যালকাটা ফ্লিম সোসাইটি” ।১৯৫২ সালে তিনি সিনেমা নির্মান শুরু করেন।তাঁর নির্মিত প্রথম সেনেমা “পথের পাঁচালী” , ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায়।মুক্তি পাওয়ার পর ছবিটি খুব দর্শক নন্দিত হয়।চলচ্চিত্র নির্মানে তিনি ছিলেন সিদ্ধ হস্ত।মোট ৩৭ টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রমাণ্যচিত্র ও স্বপ্লদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মান করেন।তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাচালী ছবিটি তাঁকে মোট ১১ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করায়।যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল কান উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কারটি।এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে বহুমুখী প্রভার বর্ণময় জীবনে পয়েছেন অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার।তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক সম্মান সূচক “ডক্টরেট” ডিগ্ৰী লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্স সরকার সত্যজিৎ রায়কে সেদেশের সম্মানসূচক “লেজিওঁ দনলে” সম্মানে ভূষিত করেন।১৯৮৫ সালে তিনি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার “দাদাসাহেন ফালকে” পুরস্কারে লাভ করেন। ১৯৯২ সালে আস্কার তাঁকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে।তাছাড়া তিনি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানা “ভারত রত্ন” লাভ করেন করে।মৃত্যুর পর তাঁকে মরণোত্তর “আকিরা কুরোসাওয়া” পুরস্কার প্রদান করা হয়।
চলচ্চিত্র নির্মাণের নেশাকে তিনি পেশা করে নিয়ে ছিলেন।১৯৮৩ সালে চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় সত্যজিৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন।হৃদরোগও সত্যজিতকে তাঁর কর্ম জীবন থেকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি চলচ্চিত্রের কাজ চালিয়ে যান।১৯৮৭ সালে তিনি অসুস্থ অবস্থায় তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এরপর তিনি ১৯৮৯ সালে “গণশক্তি” , ১৯৯০ সালে “শাখাপ্রশাখা” ও ১৯৯১ সালে “আগুন্তুক” ছবি নির্মাণ করেন।১৯৯২ সালে হৃদরোগের জটিলতা নিয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন।সেখান থেকে আর তাঁকে ফিরে আসা হন নি।১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় মৃত্যুবরণ করেন।